
মনোরমা, বয়স পঞ্চাত্তর পেরিয়েছে। এই পৃথিবীতে তিনি পরিত্যক্ত ও একা। তাঁর পরিবার বলতে যা ছিল তার কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই। একমাত্র ছেলে বাইরে থাকে। মায়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ নেই। মৃত্যুর পর সামান্য ফ্যামিলি পেনশন সম্বল করে মনোরমা কষ্টেসৃষ্টে বেঁচে থাকেন একটি সরকারি আবাসনে। প্রতি মাসের প্রথম দিনটিতে তিনি বাড়ি থেকে বের হন ব্যাঙ্কে পেনশন তুলতে। তাছাড়া সারাদিনই নিজেকে আবদ্ধ রাখেন নিজের ছোট্ট দু-কামরার ফ্ল্যাটটিতে। চারপাশে কোথায় কী হচ্ছে তার খবর মোটামুটি রাখলেও, কোনো ব্যাপারেই নিজেকে জড়ান না। কিন্তু চারপাশের আর্থ সামাজিক অবস্থা তাঁকে তাঁর বদ্ধ জীবনের থেকে বাইরে টেনে আনে। সমস্যার শুরু মনোরমার পেনশন আটকে যাওয়া দিয়ে। অনেক অনরোধ উপরোধের পরও পেনশন সমস্যার সুরাহা হয় না। মাস মাইনে না পেয়ে তার একমাত্র অবলম্বন কাজের মেয়ে হাসি কাজ করতে অস্বীকার করে। প্রায় অশক্ত মনোরমা এরপর এমন এক বিপন্নতার দিকে এগিয়ে যান যে, তিনি বাধ্য হন কলকাতার রাস্তায় ভিক্ষে করার কথাও ভাবেন। এমনই এক সময়ে তিনি জানতে পারেন কলকাতার উন্নয়নের জন্য তাঁদের ভাঙাচোড়া হাউজিংটি সরকারি উদ্যোগে ভেঙে ফেলে ওই জমিতে নতুন বাড়ি, রাস্তা ফ্লাই ওভার ইত্যাদি তৈরির পরিকল্পনা প্রায় পাকা। সকলকে এবার ওই হাউজিং ছেড়ে যেতে হবে। যদিও সরকারের এই উদ্যোগ নিয়ে বাসিন্দাদের একাংশের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। তাঁরা এই নিয়ে আবাসনের মধ্যেই ধর্না দিলেও মনোরমা নিজের স্বভাবের কারণে এতদিন কিছুই তেমন করে খেয়াল করেন নি। বিপন্ন মনোরমা বুঝতে পারেন এবার তাঁর শেষ আশ্রয়টুকুও তিনি হারাতে বসেছেন। হতাশ, মরিয়া, বিপন্ন মনোরমার আর্তি যেন সারা পৃথিবীর আশ্রয়চ্যুত মানুষের আর্তির সঙ্গে মিশে যায়। আবাসন সংলগ্ন হাসিদের বস্তি উচ্ছেদ দিয়ে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়নের কাজ শুরু হয়। মনোরমাদের আবাসন ছেড়ে যেতে বলা হয়। প্রতিবাদীদের ধর্না মঞ্চ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে মনোরমা তাঁর শেষ আশ্রয় ছেড়ে অনির্দিষ্ট, অনিশ্চিত এক পথে যাত্রা শুরু করতে গিয়ে মুহুর্তের জন্য থামেন ভেঙে ফেলা ধর্না মঞ্চের সামনে। আর তারপরই বদলে যায় সব কিছু। সাধারণ মনোরমা হয়ে ওঠেন অ – সাধারণ।