Pages

Saturday, July 23, 2011

সিনেমার মৃত্যু।


সিনেমার মৃত্যু।
শৈবাল মিত্র

সিনেমা কি ও কাকে বলে এই প্রশ্ন আজকাল কোনো পাগলেও করে না। কারণ সিনেমাকে আমরা চিনে গেছি এমনটাই মনে করি। মাল্টিপ্লেক্সে বসে পপকর্ন চিবোতে চিবোতে কান ফাটানো আওয়াজ আর বিশাল আকারের ছবির মধ্যে হারিয়ে গিয়ে ঘন্টা দুয়েক drugged stupor হয়ে থাকার অন্য নামই সিনেমা। যাকে নিয়ে আবার বাজারি খবরের কাগজে নানাবিধ চাকচিক্যময় ছবি ছাপা যায়। রাস্তার মোড়ে যার বিজ্ঞাপনে নগ্ন নারী দেহের ছবি টাঙ্গিয়ে রাখা যায়। যার নায়ক নায়িকাদের জীবনের মশলাদার গুজব ছেয়ে দেওয়া যায় ঘর গেরস্থালি, তারই নাম সিনেমা। তাই নিয়ে এত ভাবার কি আছে? টিকিট কাটো, বই দেখো, নায়ক নায়িকার জীবনযাত্রা নিয়ে গুজবে মাতো তাহলেই হয়ে গেলো। তুমিও খুশি তারাও খুশি। কোটি টাকা খরচ করে তৈরি ছবি থেকে কোটি, কোটি টাকার মুনাফা। একেই তো বলে সিনেমা।
এই সিনেমার জগতে ঠাই পেতে ও পাইয়ে দিতে এখন শহরের অলিতে গলিতে সিনেমা শেখার, সিনেমায় নামার স্কুল, অ্যাকাডেমি কত কি। একবার কপাল খুললে পাড়ার বন্ধু বান্ধব থেকে বাপ মা, মাসি পিসির সামনে বেশ দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠা যায়। অধ্যাবসায় থাকলে রাতারাতি জনপ্রিয় হিরো বা হিরোইন এমন কি পরিচালকও হয়ে যাওয়া যায়। তারপর তো পেজ থ্রি আছেই। সপ্তাহে অন্তত একবার সেখানে আবির্ভুত হতে পারলেই কেল্লা ফতে। আপাতভাবে মনে হতে পারে এ সবই বাহ্য ব্যাপার। কিন্তু আসল সমস্যা রয়েছে এখানেই। একটু ভেবে দেখলে দেখা যাবে, যেহেতু সিনেমা দর্শক নির্ভর, যেহেতু ছবি বানাতে গেলে যা খরচ হয়, তা অনেকটাই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাই দর্শক না পেলে লগ্নী করা টাকা ফেরত আসা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই ভাবনা থেকেই যাবতীয় উদ্যোগ আয়োজন চলেছে। আর তাতে সামিল ছবির প্রযোজক থেকে শুরু করে দর্শক, এমন কি মিডিয়ার সমস্ত স্তর। উদ্দেশ্য হল যে ভাবে হোক মানুষকে মাতিয়ে রাখা, ক্ষেপিয়ে রাখা। যাতে ছবি বাজারে এলে তা দেখার জন্য মানুষ হন্যে হয়ে ওঠে। টিকিটের চাহিদা আকাশ ছোঁয়।  
অনেকে হয়তো এর মধ্যে তেমন কোনো দোষ খুঁজে পাবেন না। সাদা চোখে তা পাওয়ারও কথা নয়। কিন্তু যাঁরা এই পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছবি বানাচ্ছেন তাঁরা জানেন যে এই মানসিকতা সমস্ত পরিবেশকে কতখানি বিষিয়ে তুলেছে। এই মারাত্মক বিশেই মৃত্যু হয়েছে সিনেমা নামের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী শিল্প মাধ্যমের। যে মাধ্যমকে জানতে, বুঝতে এবং গড়ে তুলতে মাধ্যমটির জন্মলগ্ন থেকেই যত ভাবনা চিন্তা হয়েছে আজ আর তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। আজ সিনেমার প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিনেমা মানে আজ ম্যাজিক। যা দেখে দর্শক কেমন থ মেরে যান। ছবির বহিরঙ্গই তাকে বেশি চমকিত করে। তার এই মানসিক অবস্থাই প্রকারান্তরে সাহায্য করছে ছবির ব্যবসা, বানিজ্যিক ছবির দুনিয়ায় এটাই নিয়ম।
এরই পাশাপাশি অন্যধারার ছবি পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল মাধ্যমটির শিল্পরূপকে নিয়ে। দুইয়ের এই সহাবস্থানে আপত্তি থাকত না যদি দেখা যেত ছবিকে বাজারজাত করতে গিয়ে বানিজ্যিক দুনিয়ার ছবি যাই করুক না কেন সে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে তাদের নিজস্ব গন্ডির মধ্যেই। কিন্তু তা না হয়ে আজ সে হাত বাড়িয়েছে অন্য ছবির গন্ডির দিকেও। দেখা যাচ্ছে, crossover cinema নামের তকমা লাগিয়ে তারা এই ঘোষনাও করে দিচ্ছে যে তারা একটা সীমাকে পার হচ্ছে। এবং যে বিষ তারা নিজেদের দুনিয়ায় ছড়িয়ে রেখেছে ব্যাবসায়িক কারণে সেই বিষই স্বাভাবিকভাবেই ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। ছুঁয়ে যাচ্ছে অন্যছবির দর্শকদের ছবির ভালোমন্দ বিচার করার ক্ষমতাকেও। ক্ষতি যদি কোথাও হয়ে গিয়ে থাকে তা হল এই জায়গাতেই। গোদে ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো যুক্ত রয়েছে টেলিভিশন নামের সর্বগ্রাসী জাত কুল গোত্রহীন মাধ্যমটি।  
ভালো ছবিকে চিনে নেবার যে ক্ষমতা বিশ্ব জুড়ে নানা যুক্তি তর্কের মধ্যে দিয়ে সিনেমার জন্মকাল থেকে দর্শক মনে গড়ে উঠেছিল সেটাই এই পরিবেশে হারিয়ে যেতে বসেছে বা বলা চলে হারিয়ে গেছে। দুঃখ সেখানেই, ক্ষতি সেখানেই। একটি শিল্প মাধ্যমের প্রথম ও শেষ নির্ভরের জায়গা তার রসিকজন। শিল্প রস আহরনের ক্ষমতা যদি রসিক হারিয়ে ফেলে তবে শিল্পর কোনো ভিত্তিই থাকে না। End of Art শিরোনামে যে বিতর্ক আজ সারা বিশ্ব জুড়ে শোনা যায় তারও অন্তর্লীন হাহাকার এই জন্যই। সিনেমাও তার থেকে মুক্ত নয়। আমাদের জীবনে মিডিয়া তার প্রচন্ড উপস্থিতি দিয়ে যখন সব কিছুকেই নির্ধারন করে দিচ্ছে তখন সিনেমার ভালো মন্দর বিচারও আমরা তার হাতেই ছেড়ে দিয়েছি। তাদের বলে দেওয়া ভালো, আজ আমাদের কাছেও ভালো। তাদের বলে দেওয়া খারাপ, আজ আমাদের কাছেও খারাপ। দর্শকের নিজেদের আর কোনো মন নেই। বিচার ক্ষমতা নেই। ছবির সমালোচনা আজ এতটাই নিকৃষ্ট জায়গায় পৌঁচেছে যে তা দিয়ে দর্শকের পক্ষে কিছু বোঝা বোধহয় সম্ভব নয়। আজকের সমালোচকদের মধ্যে সেই প্রাজ্ঞতা দেখাই যায় না যা এককালে দর্শকদের একটি ছবির ভালো মন্দ চিনতে, বুঝতে সাহায্য করত। তাই যে ছবি নিয়ে কাগজে খুব বেশি গালগল্প হয় না, খুব বেশি বিজ্ঞাপিত হয় না, বিদেশী পুরস্কার জোটে না সে ছবি দেখতে যাওয়ার ইচ্ছেও আমাদের মধ্যে জন্মায় না। এক সময় ফিল্ম সোসাইটীগুলোর উদ্যোগ এক শ্রেনীর দর্শকদের টেনে আনত ভালো ছবি দেখার দিকে। তা নিয়ে তর্কবির্তকও চলত। কিন্তু এখন সবই কেমন জানা হয়ে গিয়েছ, বোঝা হয়ে গিয়েছে জাতীয় ভাব। ভালো ছবি বলুন, নাটক বলুন, সঙ্গীত বলুন সবই যেন সৃষ্টি করা হয়ে গিয়েছে পূর্বতন রথী মহারথী শিল্পীরা। আর নতুন কোনো ভালো কাজ হবার নয়, এমনই একটা ভাব অলস জনমনে ছড়িয়ে পড়েছে।
এরপরও যে কথা বাকি থেকে যায় তা হল সিনেমার ভাষা। এই ভাষা বস্তুটি যে ঠিক কি তা অনেকের কাছেই পরিস্কার নয়। কেউ যদি বলে বসে সিনেমার সংলাপই তার ভাষার পরিচায়ক তবে কিন্তু ভুল বলা হবে। যদিও এসব নিয়ে আলোচনার জায়গা এটা নয় তবু বলা চলে, যার ভাষা বোঝার আশাটাই জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে, তাকে আর বুঝি কি করে? অথচ ভাষার মুন্সীয়ানা যেমন বড় সাহিত্যকের পরিচায়ক তেমনি বড় চলচ্চিত্রকারেও পরিচায়ক। আজ যে সব সিনেমা আমরা দেখি সেখানে কি আইজেনস্টাইন, পুডভকিন, বার্গম্যান, ফেলিনি কিংবা ঋত্বিক সত্যজিতের সমতুল্য cinematic craftsmanship দেখতে পাই? পেলেও সংখ্যায় তা খুব কম। এর কারণ হল বহু ভাবনায় গড়ে ওঠা সিনেমার আদি ভাষাকেই আমরা ভুলতে বসেছি। ছবি ও শব্দের মেলবন্ধনের যে নান্দনিকতা এককালের সিনেমায় দেখা যেত তা আজকের সিনেমায় অনুপস্থিত।   
কিন্তু তবু ভাষাটা আছে। যার সাহায্যে ছবি তৈরির কাজ কমে গেলেও একেবারে থেমে হয়ত যায়নি। কিন্তু তার কদর করার মতো রসিকজন আজ আর নেই। অনেকে বলেন, বিশ্ব জুড়ে ভালো ছবি আর তৈরিই হচ্ছে না। ভাবার সময় এসেছে ভালো ছবিকে চিনে নেবার মতো রসিক দর্শক তৈরি হচ্ছে না বলেই কি ভালো ছবি তৈরি হচ্ছে না? দর্শক চাহিদার শর্ত বানিজ্যিক ছবির দুনিয়ায় প্রথম ও শেষ কথা। অন্যধারার ছবির দুনিয়াও কি সেই শর্তকে ছুঁয়ে নেই? শিক্ষিত রসিক দর্শকই পারে তার সময়ের চলচ্চিত্রকারদের শৈল্পিক ছবি তৈরির কাজে উদ্বুদ্ধ করতে। আর সেটা হচ্ছে না (কিংবা হতে দেওয়া হচ্ছে না, কারণ রাজনীতি সর্বব্যাপী) বলেই সিনেমা নামের বিংশ শতাব্দীতে সৃষ্ট এই সমন্বয়ী শিল্প মাধ্যমটির মৃত্যু হচ্ছে ধীরে ধীরে। যে গুটিকয় শিক্ষিত দর্শক আজো এই পৃথিবীতে বেঁচে বর্তে আছেন তাদের আজ সচেতন হওয়ার সময় এসেছে।                 
             

সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ


সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ - তথ্য থেকে চিত্রে।

শৈবাল মিত্র

সত্যজিৎ রায়ের কাহিনী চিত্রগুলি নিয়ে যত আলোচনা দেখি, তাঁর তথ্যচিত্রগুলি নিয়ে তেমন চোখে পড়ে না। তিনি যে পাঁচটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাল বাঙালির কাছে স্বাভাবিক কারণেই সব থেকে বেশি জনপ্রিয়। এই ছবি আমরা যতবার দেখেছি, অন্যগুলি দেখিনি। আসলে সত্যজিৎকে আমরা মুলত একজন কাহিনীচিত্রের পরিচালক বলে জানি বলেই বোধহয় তাঁর তথ্যচিত্রগুলিকে নিয়ে খুব একটা ভাবি না। তাঁর কাহিনীচিত্রের ভাষা, ছন্দ, সুর ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা যতখানি জানি, তথ্যচিত্রের বেলায় সে জানা তেমন পর্যায় পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছয় না। এর প্রধান কারণ, তথ্যচিত্র ব্যাপারটা নিয়েই আমাদের দেশের মানুষের এক ধরণের উদাসীনতা। তথ্যচিত্র, চলচ্চিত্রের আদি জনক হয়েও কার্তিক ঠাকুরের মতো গৃহস্থের দোরগোড়ায় ফেলে না এলে পুজো পায় না। কী আর করা যাবে!
সত্যজিতের কাহিনীচিত্রগুলি নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন তাঁরা সকলেই ছবিগুলির চিত্রভাষ্যের কথা বলেছেন। তাঁর ছবির দৃশ্যাবলীর নির্মাণ, চিহ্ন ও প্রতীক দর্শককে বরাবর মুগ্ধ করেছে। অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে (ঘরে বাইরে-র আগে পর্যন্ত) তাঁর ছবির চলন ছিল দৃশ্য থেকে শব্দের দিকে। কিন্তু তথ্যচিত্রগুলির দিকে তাকালে আমরা দেখব, এই চলনটাই কেমন বদলে গিয়েছে। সেখানে এই যাত্রার মুখ শব্দ থেকে দৃশ্যের দিকে বা তথ্য থেকে চিত্রের দিকে। এ কথা তাঁর সব তথ্যচিত্রের ক্ষেত্রেই বলা যায়। ব্যাপারটা বুঝতে রবীব্দ্রনাথ ছবিটিকে নেওয়া যাক।
যাঁকে নিয়ে ছবি সেই মানুষটিকে হেলাফেলা করা চলে না, অগ্রাহ্য তো আজও করা গেল না। যাঁর জন্ম ও মৃত্যুর দিন বাঙালির তেরো পার্বণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বারো মাসে পনেরো পার্বণে পরিনত হয়েছে। এই ছবির শুরুতে বলা হচ্ছে, “On 7th August 1941… in the city of Calcutta… a man died চমকে ওঠার মতো একটা ধারাভাষ্যের লাইন। রবীন্দ্রনাথকে তাঁর নাম দিয়ে সম্বোধন না করে কেবল “a man” বলে সম্বোধনের স্পর্ধা কেন দেখালেন সত্যজিত (তিনিও ভবিষ্যতে বাঙালা চলচ্চিত্রের রবীন্দ্রনাথ হয়ে ঊঠবেন বলে)? ছবিতে তখন দেখা যাচ্ছে, কলকাতার রাস্তা জুড়ে অগণিত মানুষের স্রোতে। তাদের কাঁধে চেপে কবির মরদেহ ভেসে চলেছে নিমতলা ঘাটের দিকে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি ঠেলাঠেলির চোটে তা ছিটকে পড়বে রাস্তায়। এই দৃশ্য অরোরা ফিল্মসের সংগ্রহশালা থেকে উদ্ধার করে সত্যজিতই প্রথম জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। সেখানে যে ঠিক কী হচ্ছে, তা বোঝা কঠিন। ওই দিন এই শেষযাত্রাকে ঘিরে চুড়ান্ত নৈরাজ্যর স্মৃতি আমরা নানান লেখায় পড়েছি। ছবিতে যার প্রমাণ স্পষ্ট। এমন একটি দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনের মধ্যে কেমন একটা অসহায়তা ফুটে ওঠে না কি? তখন মনে হয় না কি এ কি করছে মানুষগুলো! কার দেহ নিয়ে তারা চলেছে, তা কি ভুলে গিয়েছে? মানুষটি কি এমন হেলাফেলার যোগ্য? এই অনুভুতির সঙ্গে তখন অনায়াসে খাপ খেয়ে যায় সত্যজিতের উক্তি “a man”, তাই না? যে চলনের কথা বলে শুরু করেছিলাম, দেখা যাচ্ছে ছবির শুরুতে তা ঘটেছে দৃশ্য থেকে শব্দের দিকে। বেশ, কিন্তু তারপর?
      এরপরই কিন্তু চলন গিয়েছে ঘুরে। ‘his mortal remains perished but he left behind him a heritage that no fire could consume…’ ছবি বদলে গেল অন্ধকারের মধ্যে প্রজ্জ্বলিত এক চিতার দৃশ্যে। শুরু হল শব্দ থেকে দৃশ্যের দিকে যাত্রা। চিতাটি জ্বলছেই চলেছে আর ভাষ্যকার বলে চলেছেন, “It is a heritage of words and music and poetry, of ideas and of ideals, and it has the power to move us, to inspire us today and in the days to come. We, who owe him so much salute his memory। ছবি বদলায়। দেখা যায় দিগন্তে সূর্যোদয়। ভেসে ওঠে গান, জয় হোক নব অরুণোদয়, জয় হোক। আবার শব্দ থেকে দৃশ্যের দিকে যাওয়া।
     সত্যজিৎ তা হলে কোনও স্পর্ধা দেখান নি, বরং অত্যন্ত নম্রভাবে প্রণাম জানিয়েছেন তাঁকেই, যিনি ভেতরে-ভেতরে তৈরি করেছেন তাঁকে। যাঁর মৃত্যুর খবর বন্ধু শিল্পী দীনকর কৌশিকের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের খোয়াইয়ে বেড়াতে গিয়ে তিনি পেয়েছিলেন, আর তৎক্ষণাৎ ঠিক করেছিলেন শান্তিনিকেতন ছাড়বেন। কারণ, ততদিনে তিনি ভাবতে শুরু করেছেন, জীবনে কী করবেন, কী হয়ে উঠবেন। মনে হয়েছিল, ভারতে শিল্পের নানা ধারায় তো এসে গিয়েছেন নন্দলাল (চিত্রকলা) রবীন্দ্রনাথ (সাহিত্য) রামকিঙ্করের (ভাস্কর্য) মতো দিকপাল মানুষ। সঙ্গীতে তো কথাই নেই। তা হলে স্থান কোথায় তাঁর? শিল্পের এমন কোন অলিন্দে গিয়ে দাঁড়াবেন তিনি, যেখানে তাঁকে ধারণ করার মতো জায়গা আছে! তাই বেছে নিয়েছিলেন বিংশ শতাব্দীর এক নতুন শিল্প মাধ্যম চলচ্চিত্রকে।
      সত্যজিতের তথ্যচিত্রগুলি শুরু হয় খুব সহজ ধারাভাষ্যের লাইন দিয়ে। যেমন, “on 7th of August, 1941, in the city of Calcutta, a man died” (রবীন্দ্রনাথ)। অথবা এই ছবিগুলোর সঙ্গে পরিচিত নন, এমন বাঙালি খুব কমই আছেন (সুকুমার রায়)। কিন্তু ক্রমশ ছবি দুটি পৌঁছে যায় এক অপার গভীরতায়। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের গানের মতো। রবীন্দ্রনাথ তথ্যচিত্রে সেই সূর্যোদয়ের ছবির ওপর ফুটে উঠছে টাইটেল, Films Division Presents/ Rabindrath Tagore এবং Through Satyajit Ray। এই ‘Through’ ব্যাপারটা লক্ষ্য করার মতো। অর্থাৎ বিরাট এক ব্যক্তিত্বের জীবনী আমরা প্রত্যক্ষ করতে চলেছি আর এক প্রতিভাধর ব্যক্তিত্বের মধ্যে দিয়ে। রতন চেনাচ্ছে রতনকে, আমরা দর্শক মাত্র। এই চেনার সঙ্গে আমাদের চেনা মিলতেও পারে, আবার নাও পারে। সে আলোচনার ক্ষেত্র আমার এক্তিয়ারের বাইরে।
      সত্যজিতের তথ্যচিত্র নির্মাণের যে ধরন, তার আদিতে থাকত তথ্যের ধারাভাষ্য বা উচ্চারিত শব্দমালা ও সঙ্গীত। যার সঙ্গে তাল রেখে আসত ছবি বা শট। মনে হয়, ছবির বিষয় নিয়ে তথ্য সংগ্রহের পর তিনি প্রথমেই লিখতেন ধারাভাষ্যটি। সেটি লেখার সময় খেয়াল রাখতেন, কী কী চলমান দৃশ্য বা স্থিরচিত্র তাঁর হাতের কাছে রয়েছে, সেগুলি কেমন বা কতটা জোরালো এবং কার্যকরী। সেই অনুযায়ী তিনি ধারাভাষ্যের শব্দ চয়ন করতেন বা চয়ন করা শব্দের অনুযায়ী ছবি তৈরি করতেন। যেমন ‘no fire could consume’ লাইনটির সঙ্গে জলন্ত চিতার দৃশ্যের ব্যবহার। অথবা রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথের মাতামহ, বালক ও তরুণ রবীন্দ্রনাথের ছবির অভাবে অভিনেতার সাহায্য অভিনীত দৃশ্যের ব্যবহার। এসব ক্ষেত্রে ধারাভাষ্যের লাইনই প্রাধান্য পেয়েছে। সেটা করতে গিয়ে ছবির পরিধির যতটা প্রয়োজন পড়েছে, তাঁকে তৈরি করে নিতে হয়েছে নিজের কল্পনা দিয়ে। আর তাতেই চলনের গতিমুখ বদলেছে। এমন উদাহরণ আরও দেওয়া যায়।
      তথ্যচিত্র তৈরির এই পদ্ধতিকে আমরা পেয়েছি ইংরেজদের কাছ থেকে। টেলিভিশন আসার আগে পর্যন্ত এই পদ্ধতিই মোটামুটি ভাবে চালু ছিল সব দেশে। ইংরেজ তথ্যচিত্রকার John Grierson ও মার্কিন তথ্যচিত্রকার Robert Flaherty- কে এই ধারার জনক বলা হয়। আজও আমাদের দেশে যে সব তথ্যচিত্র তৈরি হয়, তাতে এই ধারাটির ছাপই স্পষ্ট ধরা পড়ে। তবে এর মধ্যেও রকমফের আছে। ধারাভাষ্য অনুযায়ী দৃশ্য যুক্ত করার কাজটা সহজ নয়। এখানেই দরকার হয় পরিচালকের কল্পনা ও সম্পাদনার মুন্সিয়ানা। সত্যজিতের তথ্যচিত্রে এই মুন্সিয়ানার ও কল্পনার ব্যপ্তি অবাক করার মতো। ভাষ্য পাঠের ধরন, সঙ্গীতের ব্যবহার ও শব্দের পরতের সঙ্গে ছবি বা শটের মেলবন্ধন তাঁর তথ্যচিত্রে এমন এক ছন্দের, আবেশের জন্ম দেয়, যা সহজে দেখা যায় না। এখানেই তাঁর তথ্যচিত্রের অন্যন্যতা। আর যে ব্যাপারটা তাঁর কাহিনী চিত্র তথা তথ্যচিত্রের ক্ষেত্রে সমান সত্যি, তা হল পরিমিতের বোধ। এ লোভ সামলানো বড় সহজ কাজ নয়।
      তবে আজকের দিনে সত্যজিতের তথ্যচিত্রগুলি দেখতে বসে একালের চলচ্চিত্রকারদের যেটা চোখে পড়বে তা হল, প্রযুক্তিগত খামতি। রবীন্দ্রনাথ ছবিতেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সত্যজিতের সময় পর থেকে আজ অবধি চলচ্চিত্র তৈরির প্রযুক্তি অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। তাঁর সময়ে যে সব ক্যামেরা বা সম্পাদনার যন্ত্র ব্যবহার হত, তা দিয়ে আজ যতটা নিখুঁত পর্যায়ে আমরা পৌঁছতে পারি, ততটা একেবারেই অসম্ভব ছিল। ফলে ক্যামেরা নাড়ানোচড়ানোর মাঝে ছোটখাটো হোঁচট বা শট কাটার ক্ষেত্রে সঠিক ফ্রেমটিকে না ধরতে পারা বা শব্দের মিশ্রণসুক্ষতার অভাবএই ব্যাপারগুলো ত্থেকেই গিয়েছে। তখন সিনেমা তৈরি করা ব্যাপারটা ছিল কায়িক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। চলচ্চিত্রকারের ঘাম রক্তের সঙ্গে মিশে থাকত সেকালের সিনেমা। আজ সবটাই ইঁদুরের (মাউস) কারবার।
     তবু বলতে হয়, এত কিছু পেয়েও আমরা আজও পারিনি আর একটি রবীন্দ্রনাথ, ইনার আই, বালা, সিকিম বা সুকুমার রায় তৈরি করতে। আর তখনই মনে প্রশ্ন জাগে, সিনেমা ব্যাপারটা কি শুধুই প্রযুক্তিগত শিল্প না কি মজ্জাগত?         
                   

Monday, February 21, 2011

Rabindranath


Rabindranath Tagore (1861-1941) was the youngest son of Debendranath Tagore, a leader of the Brahmo Samaj, which was a new religious sect in nineteenth-century Bengal and which attempted a revival of the ultimate monistic basis of Hinduism as laid down in the Upanishads. He was educated at home; and although at seventeen he was sent to England for formal schooling, he did not finish his studies there. In his mature years, in addition to his many-sided literary activities, he managed the family estates, a project which brought him into close touch with common humanity and increased his interest in social reforms. He also started an experimental school at Shantiniketan where he tried his Upanishadic ideals of education. From time to time he participated in the Indian nationalist movement, though in his own non-sentimental and visionary way; and Gandhi, the political father of modern India, was his devoted friend. Tagore was knighted by the ruling British Government in 1915, but within a few years he resigned the honour as a protest against British policies in India.
Tagore had early success as a writer in his native Bengal. With his translations of some of his poems he became rapidly known in the West. In fact his fame attained a luminous height, taking him across continents on lecture tours and tours of friendship. For the world he became the voice of India's spiritual heritage; and for India, especially for Bengal, he became a great living institution.
Although Tagore wrote successfully in all literary genres, he was first of all a poet. Among his fifty and odd volumes of poetry are Manasi (1890) [The Ideal One], Sonar Tari (1894) [The Golden Boat], Gitanjali (1910) [Song Offerings], Gitimalya (1914) [Wreath of Songs], and Balaka (1916) [The Flight of Cranes]. The English renderings of his poetry, which include The Gardener (1913), Fruit-Gathering (1916), and The Fugitive (1921), do not generally correspond to particular volumes in the original Bengali; and in spite of its title, Gitanjali: Song Offerings (1912), the most acclaimed of them, contains poems from other works besides its namesake. Tagore's major plays are Raja (1910) [The King of the Dark Chamber], Dakghar (1912) [The Post Office], Achalayatan (1912) [The Immovable], Muktadhara (1922) [The Waterfall], and Raktakaravi (1926) [Red Oleanders]. He is the author of several volumes of short stories and a number of novels, among them Gora (1910), Ghare-Baire (1916) [The Home and the World], and Yogayog (1929) [Crosscurrents]. Besides these, he wrote musical dramas, dance dramas, essays of all types, travel diaries, and two autobiographies, one in his middle years and the other shortly before his death in 1941. Tagore also left numerous drawings and paintings, and songs for which he wrote the music himself.