সিনেমার মৃত্যু।
শৈবাল মিত্র
সিনেমা
কি ও কাকে বলে এই প্রশ্ন আজকাল কোনো পাগলেও করে না। কারণ সিনেমাকে আমরা চিনে গেছি
এমনটাই মনে করি। মাল্টিপ্লেক্সে বসে পপকর্ন চিবোতে চিবোতে কান ফাটানো আওয়াজ আর
বিশাল আকারের ছবির মধ্যে হারিয়ে গিয়ে ঘন্টা দুয়েক drugged
stupor হয়ে থাকার অন্য নামই সিনেমা। যাকে নিয়ে আবার বাজারি খবরের
কাগজে নানাবিধ চাকচিক্যময় ছবি ছাপা যায়। রাস্তার মোড়ে যার বিজ্ঞাপনে নগ্ন নারী দেহের
ছবি টাঙ্গিয়ে রাখা যায়। যার নায়ক নায়িকাদের জীবনের মশলাদার গুজব ছেয়ে দেওয়া যায় ঘর
গেরস্থালি, তারই নাম সিনেমা। তাই নিয়ে এত ভাবার কি আছে? টিকিট কাটো, ‘বই’ দেখো, নায়ক নায়িকার জীবনযাত্রা নিয়ে গুজবে মাতো
তাহলেই হয়ে গেলো। তুমিও খুশি তারাও খুশি। কোটি টাকা খরচ করে তৈরি ছবি থেকে কোটি,
কোটি টাকার মুনাফা। একেই তো বলে সিনেমা।
এই
সিনেমার জগতে ঠাই পেতে ও পাইয়ে দিতে এখন শহরের অলিতে গলিতে সিনেমা শেখার, সিনেমায় ‘নামা’র স্কুল,
অ্যাকাডেমি কত কি। একবার কপাল খুললে পাড়ার বন্ধু বান্ধব থেকে বাপ মা, মাসি পিসির
সামনে বেশ দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠা যায়। অধ্যাবসায় থাকলে রাতারাতি জনপ্রিয় হিরো বা
হিরোইন এমন কি পরিচালকও হয়ে যাওয়া যায়। তারপর তো পেজ থ্রি আছেই। সপ্তাহে অন্তত
একবার সেখানে আবির্ভুত হতে পারলেই কেল্লা ফতে। আপাতভাবে মনে হতে পারে এ সবই বাহ্য
ব্যাপার। কিন্তু আসল সমস্যা রয়েছে এখানেই। একটু ভেবে দেখলে দেখা যাবে, যেহেতু
সিনেমা দর্শক নির্ভর, যেহেতু ছবি বানাতে গেলে যা খরচ হয়, তা অনেকটাই বাড়িয়ে দেওয়া
হয়েছে তাই দর্শক না পেলে লগ্নী করা টাকা ফেরত আসা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই ভাবনা
থেকেই যাবতীয় উদ্যোগ আয়োজন চলেছে। আর তাতে সামিল ছবির প্রযোজক থেকে শুরু করে দর্শক,
এমন কি মিডিয়ার সমস্ত স্তর। উদ্দেশ্য হল যে ভাবে হোক মানুষকে মাতিয়ে রাখা,
ক্ষেপিয়ে রাখা। যাতে ছবি বাজারে এলে তা দেখার জন্য মানুষ হন্যে হয়ে ওঠে। টিকিটের
চাহিদা আকাশ ছোঁয়।
অনেকে
হয়তো এর মধ্যে তেমন কোনো দোষ খুঁজে পাবেন না। সাদা চোখে তা পাওয়ারও কথা নয়। কিন্তু
যাঁরা এই পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছবি বানাচ্ছেন তাঁরা জানেন যে এই মানসিকতা সমস্ত
পরিবেশকে কতখানি বিষিয়ে তুলেছে। এই মারাত্মক বিশেই মৃত্যু হয়েছে সিনেমা নামের একটি
অত্যন্ত শক্তিশালী শিল্প মাধ্যমের। যে মাধ্যমকে জানতে, বুঝতে এবং গড়ে তুলতে মাধ্যমটির
জন্মলগ্ন থেকেই যত ভাবনা চিন্তা হয়েছে আজ আর তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। আজ সিনেমার
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিনেমা মানে আজ ম্যাজিক। যা দেখে
দর্শক কেমন থ মেরে যান। ছবির বহিরঙ্গই তাকে বেশি চমকিত করে। তার এই মানসিক অবস্থাই
প্রকারান্তরে সাহায্য করছে ছবির ব্যবসা, বানিজ্যিক ছবির দুনিয়ায় এটাই নিয়ম।
এরই
পাশাপাশি অন্যধারার ছবি পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল মাধ্যমটির শিল্পরূপকে নিয়ে।
দুইয়ের এই সহাবস্থানে আপত্তি থাকত না যদি দেখা যেত ছবিকে বাজারজাত করতে গিয়ে
বানিজ্যিক দুনিয়ার ছবি যাই করুক না কেন সে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে তাদের নিজস্ব
গন্ডির মধ্যেই। কিন্তু তা না হয়ে আজ সে হাত বাড়িয়েছে অন্য ছবির গন্ডির দিকেও। দেখা
যাচ্ছে, crossover cinema
নামের তকমা লাগিয়ে তারা এই ঘোষনাও করে দিচ্ছে যে তারা একটা সীমাকে পার হচ্ছে। এবং
যে বিষ তারা নিজেদের দুনিয়ায় ছড়িয়ে রেখেছে ব্যাবসায়িক কারণে সেই বিষই
স্বাভাবিকভাবেই ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। ছুঁয়ে যাচ্ছে অন্যছবির দর্শকদের ছবির
ভালোমন্দ বিচার করার ক্ষমতাকেও। ক্ষতি যদি কোথাও হয়ে গিয়ে থাকে তা হল এই জায়গাতেই।
গোদে ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো যুক্ত রয়েছে টেলিভিশন নামের সর্বগ্রাসী জাত কুল গোত্রহীন মাধ্যমটি।
ভালো
ছবিকে চিনে নেবার যে ক্ষমতা বিশ্ব জুড়ে নানা যুক্তি তর্কের মধ্যে দিয়ে সিনেমার
জন্মকাল থেকে দর্শক মনে গড়ে উঠেছিল সেটাই এই পরিবেশে হারিয়ে যেতে বসেছে বা বলা চলে
হারিয়ে গেছে। দুঃখ সেখানেই, ক্ষতি সেখানেই। একটি শিল্প মাধ্যমের প্রথম ও শেষ
নির্ভরের জায়গা তার রসিকজন। শিল্প রস আহরনের ক্ষমতা যদি রসিক হারিয়ে ফেলে তবে
শিল্পর কোনো ভিত্তিই থাকে না। End of Art শিরোনামে যে বিতর্ক আজ সারা বিশ্ব জুড়ে শোনা যায় তারও অন্তর্লীন হাহাকার
এই জন্যই। সিনেমাও তার থেকে মুক্ত নয়। আমাদের জীবনে মিডিয়া তার প্রচন্ড উপস্থিতি
দিয়ে যখন সব কিছুকেই নির্ধারন করে দিচ্ছে তখন সিনেমার ভালো মন্দর বিচারও আমরা তার
হাতেই ছেড়ে দিয়েছি। তাদের বলে দেওয়া ভালো, আজ আমাদের কাছেও ভালো। তাদের বলে দেওয়া
খারাপ, আজ আমাদের কাছেও খারাপ। দর্শকের নিজেদের আর কোনো মন নেই। বিচার ক্ষমতা নেই।
ছবির সমালোচনা আজ এতটাই নিকৃষ্ট জায়গায় পৌঁচেছে যে তা দিয়ে দর্শকের পক্ষে কিছু
বোঝা বোধহয় সম্ভব নয়। আজকের সমালোচকদের মধ্যে সেই প্রাজ্ঞতা দেখাই যায় না যা
এককালে দর্শকদের একটি ছবির ভালো মন্দ চিনতে, বুঝতে সাহায্য করত। তাই যে ছবি নিয়ে
কাগজে খুব বেশি গালগল্প হয় না, খুব বেশি বিজ্ঞাপিত হয় না, বিদেশী পুরস্কার জোটে না
সে ছবি দেখতে যাওয়ার ইচ্ছেও আমাদের মধ্যে জন্মায় না। এক সময় ফিল্ম সোসাইটীগুলোর
উদ্যোগ এক শ্রেনীর দর্শকদের টেনে আনত ভালো ছবি দেখার দিকে। তা নিয়ে তর্কবির্তকও
চলত। কিন্তু এখন সবই কেমন জানা হয়ে গিয়েছ, বোঝা হয়ে গিয়েছে জাতীয় ভাব। ভালো ছবি
বলুন, নাটক বলুন, সঙ্গীত বলুন সবই যেন সৃষ্টি করা হয়ে গিয়েছে পূর্বতন রথী মহারথী
শিল্পীরা। আর নতুন কোনো ভালো কাজ হবার নয়, এমনই একটা ভাব অলস জনমনে ছড়িয়ে পড়েছে।
এরপরও
যে কথা বাকি থেকে যায় তা হল সিনেমার ভাষা। এই ভাষা বস্তুটি যে ঠিক কি তা অনেকের
কাছেই পরিস্কার নয়। কেউ যদি বলে বসে সিনেমার সংলাপই তার ভাষার পরিচায়ক তবে কিন্তু
ভুল বলা হবে। যদিও এসব নিয়ে আলোচনার জায়গা এটা নয় তবু বলা চলে, যার ভাষা বোঝার
আশাটাই জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে, তাকে আর বুঝি কি করে? অথচ ভাষার মুন্সীয়ানা যেমন বড়
সাহিত্যকের পরিচায়ক তেমনি বড় চলচ্চিত্রকারেও পরিচায়ক। আজ যে সব সিনেমা আমরা দেখি
সেখানে কি আইজেনস্টাইন, পুডভকিন, বার্গম্যান, ফেলিনি কিংবা ঋত্বিক সত্যজিতের
সমতুল্য cinematic craftsmanship দেখতে পাই?
পেলেও সংখ্যায় তা খুব কম। এর কারণ হল বহু ভাবনায় গড়ে ওঠা সিনেমার আদি ভাষাকেই আমরা
ভুলতে বসেছি। ছবি ও শব্দের মেলবন্ধনের যে নান্দনিকতা এককালের সিনেমায় দেখা যেত তা
আজকের সিনেমায় অনুপস্থিত।
কিন্তু
তবু ভাষাটা আছে। যার সাহায্যে ছবি তৈরির কাজ কমে গেলেও একেবারে থেমে হয়ত যায়নি।
কিন্তু তার কদর করার মতো রসিকজন আজ আর নেই। অনেকে বলেন, বিশ্ব জুড়ে ভালো ছবি আর
তৈরিই হচ্ছে না। ভাবার সময় এসেছে ভালো ছবিকে চিনে নেবার মতো রসিক দর্শক তৈরি হচ্ছে
না বলেই কি ভালো ছবি তৈরি হচ্ছে না? দর্শক চাহিদার শর্ত বানিজ্যিক ছবির দুনিয়ায়
প্রথম ও শেষ কথা। অন্যধারার ছবির দুনিয়াও কি সেই শর্তকে ছুঁয়ে নেই? শিক্ষিত রসিক
দর্শকই পারে তার সময়ের চলচ্চিত্রকারদের শৈল্পিক ছবি তৈরির কাজে উদ্বুদ্ধ করতে। আর সেটা
হচ্ছে না (কিংবা হতে দেওয়া হচ্ছে না, কারণ রাজনীতি সর্বব্যাপী) বলেই সিনেমা নামের
বিংশ শতাব্দীতে সৃষ্ট এই সমন্বয়ী শিল্প মাধ্যমটির মৃত্যু হচ্ছে ধীরে ধীরে। যে
গুটিকয় শিক্ষিত দর্শক আজো এই পৃথিবীতে বেঁচে বর্তে আছেন তাদের আজ সচেতন হওয়ার সময়
এসেছে।