Pages

Tuesday, April 10, 2012

অবিশুদ্ধ সিনেমার হাতিমি দশা, এবং নিমাই, বারীন প্রভৃতিরা



অবিশুদ্ধ সিনেমার হাতিমি দশা, এবং নিমাই, বারীন প্রভৃতিরা

শৈবাল মিত্র



…film is assimilating the tremendous capital of the subjects developed and gathered around it by its neighbours over the course of hundred years. It borrows them because it needs them, and we wish to rediscover them through it. – Andre' Bazin

"তিমি ভাবে জলে যাই
হাতি ভাবে এই বেলা
জঙ্গলে চলো ভাই" সুকুমার রায়

বারীন সাহাকে আমি কখন দেখিনি। তবে তাঁর কথা অনেক শুনেছি। নিমাই ঘোষ, ঋত্বিক ঘটক ও বারীন সাহা এই তিন চলচ্চিত্রকারকে নিয়ে একটা আলাদা উত্তেজনা ছিল আমাদের মধ্যে। মৃণাল সেন ও সত্যজিৎ রায় ছিলেন দুই প্রধান সেনাপতির মতো। যাঁরা বাংলা অন্যধারার চলচ্চিত্রকে দেশে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের ছবি যেন আমাদের সরকারি চাকরি নির্ভর মধ্যবিত্ত নিরাপত্তার বাইরে বেঁচে থাকার ছাড়পত্র। যদিও টালিগঞ্জের স্টুডিও চত্বরে ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। সেখানে আজকের মতো মিডিয়ার অভিভাবকগিরি না থাকায়, মুড়ি মিছরির এক দর। সকলেই সেখানে সিনেমার কারিগর। বড় ছোট নেই। কিন্তু আমি টালিগঞ্জে কাজ করতে এসেছিলাম এমন এক সময়ে যখন, শেষবারের মতো বাংলা সিনেমা, শিল্পের আঙিনায় প্রবেশ করার একটা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে রণে ভঙ্গ দেবে। ঢুকে পড়বে বাণিজ্য ও শিল্পের মেলবন্ধনের এক ইউটোপিয়ায়। যেখানে দাঁড়িয়ে আশা করা হবে সিনেমার বিনোদন মূল্য ও শিল্প মূল্য, দুই দিকই ডানা মেলে সিনেমাপ্রেমী ও প্রযোজকদের আনন্দ দেবে। মানে, শাপ মরবে কিন্তু লাঠিটি ভাঙবে না।
বারীন সাহা (ছবি -জ্যোতিপ্রকাশ মিত্র)

এই হাতিমির দশা লাগার আগে যাঁরা তখনও সিনেমাকে এক শিল্প মাধ্যম ভেবে ছবি করার চেষ্টা করছিল, তাঁরা সত্যজিত রায় ও মৃণাল সেনের পরে যাঁদের ছবির ব্যাপারে আগ্রহী ছিল, তাঁদের মধ্যে ঋত্বিক ছিলেন সবার আগে। আর ছিলেন নিমাই ঘোষ ও বারীন সাহা যদিও তখন নিমাই ঘোষ 'ছিন্নমূল' নামে এক অবাক করা ছবি বানানোর পরও বাংলা ছাড়া আর বারীন সাহা, 'তেরো নদীর পারে'-র মতো এক অনবদ্য ছবি বানিয়ে, স্বেচ্ছায় মেদিনীপুরের এক অজ গ্রামে বসে গ্রামের মানুষদের শিক্ষাদানে ব্রতী। ব্যাপারটা ঠিক বুঝে ওঠা যেতো নাকেন যে এঁরা আর ছবি করছেন না! কেনই বা অমন অজ পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছেন, বুঝে উঠতে অনেক বছর লেগেছিল। আজ কিন্তু বুঝতে পারি, নিমাই ঘোষ ও বারীন সাহার হতাশা আর যন্ত্রণাকে অন্যধারার চলচ্চিত্রকারদের সেই যন্ত্রণার রূপ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। সিনেমা তার বিশুদ্ধতা ছেড়ে অবিশুদ্ধতার পথে হাঁটতে গিয়ে বানিজ্যিকতার পাঁকে আরো বেশি নিমজ্জিত হয়ে গেছে। কবে যে সে আবার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবে তা হলফ করে বলা শক্ত।

যে দমবন্ধ করা পরিবেশ ও পরিস্থিতি নিয়ে আজকের অন্যধারার চলচ্চিত্রকাররা বিক্ষুব্ধ বোধ করেন তার অশনি সংকেত কিন্তু নিমাইবাবু ও বারীনবাবু অনেক আগেই পেয়েছিলেন। আর ঋত্বিক ঘটক তা বুঝলেও ময়দান ছেড়ে যেতে রাজি ছিলেন না বলে, গোটা আটেক কাহিনী চিত্র, খান এগারো ছোট ছবি আর পাঁচটা শেষ না করতে পারা ছবির ভাণ্ডার আমাদের জন্য রেখে গেছেন নিজের চলচ্চিত্র ভাবনার জমি থেকে একচুলও না নড়ে নিমাই ঘোষ রেখে গিয়েছেন, একটি বাংলা ও দুটি তামিল ছবি। কিন্তু বারীন সাহা রেখে গেছেন কেবল একটি কাহিনী চিত্র, তাও সেটা দৈর্ঘ্যে প্রচলিত কাহিনী চিত্রের মাপের থেকে অনেক ছোটআর তিনটে ছোট ছবি। এই নিয়ে কেউ যে অমরত্ব লাভ করবেন, এমন আশা নিতান্তই দুরাশাকিন্তু কী অবাক করা কাণ্ড, যে নিমাই ঘোষ ও বারীন সাহাকে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেওয়ার সব রকম প্রক্রিয়া তাঁদের জীবতকালে ও পরবর্তী সময়ে বেশ জোরালো ভাবে জারি থাকলেও মানুষ দুটিকে একেবারে পগার পার করে দেওয়া যায়নি। নানা কারণে পরের প্রজন্মের অন্যধারার চলচ্চিত্র প্রেমীদের স্মৃতিতে তাঁরা বারে বারে ফিরে আসেন।

ঋত্বিক ঘটককে তাঁর জীবৎকালে নানা অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা দিয়েও আজকের বিশ্বায়ানের বাজার তাঁর ছবির সেলভ্যালু তৈরি করে নিয়ে ঝাঁ চকচকে মাল্টিপ্লেক্সের দোকান ঘরে ঠাঁই দিয়েছে। বিজ্ঞাপনের পাতায় তাঁকে লিজেন্ড হিসেবে হাজির করাচ্ছেনানা সময়ে তাঁকে নিয়ে আলাপ আলোচনা, কিংবা উৎসব আয়োজনে পয়সা ঢালতেও রাজি থাকেন কোনও বাণিজ্যিক সংস্থাকিন্তু বেচারা নিমাই ঘোষ ও বারীন সাহা, এঁদের ছবির একটি DVD খুঁজে পাওয়া দুস্কর। এঁদের ভরসা সেই প্রান্তিক চলচ্চিত্রপ্রেমীদের দল যাদের না আছে চাল, না আছে চুলো। তবু তাদেরই উদ্যোগে এঁদের ছবি কখনো কখনো আমরা দেখতে পাই, আলোচনা শুনি। ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে নিমাই ঘোষ, বারীন সাহা আজও প্রান্তিক চলচ্চিত্রকারদের কাছে আইকন। যেন গুপ্ত, বে-আইনি, বেয়াদপ কোনও সংঘের মন্ত্র গুরু এঁরা 

আসলে, চলচ্চিত্রের বানিজ্যিকতার মধ্যে না ঢুকে যাঁরা মাধ্যমটির শরীরে শিল্পের ছোঁয়া লাগাতে গেছেন তারা সব সময়, সব কালেই তাঁদের এই বেয়াদপীর জন্য তিরস্কৃত হয়েছেন বা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। বাংলায় সেই নিমাই ঘোষ থেকে শুরু করে হাল আমলে অনেকেই আছেন যাঁরা ভাল শিল্পসম্মত ছবি করলেও যেহেতু সিনেমার বানিজ্যবিধির বাইরে দাঁড়িয়ে সেই ছবি করেছেন, তাই সিনেমাকে সাধারণের কাছে নিয়ে যাওয়ার যে পরিকাঠামো রয়েছে সেখানে তাঁদের ছবি ঢুকতে দেওয়া হয়নি। নিমাই ঘোষ ও বারীন সাহার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অথচ অবাক হতে হয় ঋত্বিকদা ঘটককে দেখে। যতোই তাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে ততই যেন তিনি জেদের বসে লড়ে গেছেন। রিলিজ করতে না পারলেও ছবি করা থামান নি। যাঁরা সিনেমা বানান, তাঁরা জানেন এই লড়াই-এর চেহারা কতখানি ভয়ঙ্করআজ যখন তাঁর ছবি নিয়ে আলোচনা হয় বা দেখানো হয় তখন কারও জানাই হয় না ওই সব ছবি করতে, তাঁকে কত যন্ত্রনা, অপমান, অনিশ্চিয়তা ও লাঞ্ছনার পথ পার হতে হয়েছে অবশ্য এ কথা কেবল ঋত্বিক ঘটকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এমন নয়। সত্যজিৎ, মৃণালের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। সিনেমা বানানো সহজ কাজ নয়। তা যদি আবার প্রথাগত বানিজ্যবিধিকে না মেনে বানানোর চেষ্টা হয় তা হলে তো কথাই নেই। সবাই এই পথ পার হতে পারেন না। তবে পার হয়ে আসতে পারলে সুনামের অভাব হয় না। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও খ্যাতি পেলে কাজের ক্ষেত্র কিছুটা সহজ হয়ে আসে। সব দেশের অন্যধারার চলচ্চিত্রকারদের এই লড়াইটা লড়তেই হয়। তবে কোনও কোনও দেশে চলচ্চিত্রকাররা এমন পরিবেশ পান, যেখানে অন্যধারার ছবি বানানোর একটা পরিধি সামাজিকভাবে নির্দিষ্ট থাকে আর সে পরিধিটা তৈরি করে দেন, ছবি যারা দেখেছেন তারা আর সে দেশের আর্থ সামাজিক পরিবেশতাই সুস্থ, শিল্পসম্মত ছবির জগতে দর্শকদের ছবি দেখতে আসার একটা বড় ভূমিকা থাকে। তাদের এই সচেতনতা চলচ্চিত্রকারদের শিল্পসম্মত ছবি তৈরি করার রাস্তা তৈরি করে দেয়।

ন্যাড়া বেলতলায় কবার যায় তার হিসেব কেউ কষতে পারলেও, মানুষ শিল্পের কাছে কখন যায় আর কেনই বা যায় তার হদিশ বোধ হয় আজও পাওয়া গেল না। আর এই হিসেব পাওয়া আর সব শিল্পীর থেকে সিনেমা শিল্পীর কাছে অনেক বেশি জরুরীএর প্রধান কারণ, সিনেমা বানাতে যত টাকার প্রয়োজন হয় আর কোনও শিল্প সৃষ্টি করতে গেলে বোধ হয় ততটা লাগে না। লগ্নি করা টাকা যেহেতু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্য কেউ দেন, তাই সে টাকা আবার ফিরিয়ে নেওয়ার একটা তাগিদ স্বাভাবিক কারণেই থেকে যায়। সিনেমা মূলত একটি ব্যবসায়িক কর্ম না শিল্পকর্ম এই বিতর্কে না ঢুকে যেটা মেনে নিতেই হবে সেটা হল, সিনেমা এমন একটি শিল্প মাধ্যম যার জন্ম বাজার অর্থনীতির মধ্যে থেকে। ফলে এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাজারনীতির ছাপ স্পষ্ট। টাকা ছাড়া সিনেমা তৈরি কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। মুসকিল হল, এই দ্বৈত্য সিনেমা শিল্পটিকে সুকুমার রায়ের 'হাতিমি'তে পরিণত করেছে। যেখানে পরিচালক ও প্রযোজক সংলাপ অনেকটা, "তিমি ভাবে জলে যাই/ হাতি ভাবে এই বেলা জঙ্গলে চলো ভাই" এর মতোদুনিয়া জুড়ে এই সংলাপই নানা ভাষায়, নানা ভঙ্গিতে হয়ে চলেছে সিনেমার জন্মের পর যেদিন থেকে বিশুদ্ধতা ছেড়ে অবিশুদ্ধতার দিকে হাঁটতে চেয়েছে সেদিন থেকেই তাই সিনেমা কার? - পরিচালকের না প্রযোজকের, এই দ্বন্দ্বের অবসান হয় না।   

আর তাই নিমাই ঘোষ বা বারীন সাহাকে এই বাংলার চলচ্চিত্র জগৎ ছেড়ে চলে যেতে হয় চেন্নাই বা মেদিনীপুরের গ্রামে। হতাশায় ভুগে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়তে হয় ঋত্বিক ঘটককে, মৃণাল ও সত্যজিতকে সরে আসতে হয় অপেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে স্টুডিওর বাইরে গিয়ে ছবি করার জগৎ থেকে বক্স অফিসখ্যাত পেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে স্টুডিও নির্ভর ছবির জগতে ঋত্বিক, সত্যজিত ও মৃণালের ছবি ঘিরে আমাদের একটা ধারনা থাকলেও মনে রাখতে হবে, নিমাই ঘোষ ও বারীন সাহা যে সিনেমা তৈরি করেছিলেন চলচ্চিত্র শিল্পের বিচারে তা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখেকিন্তু বানিজ্যবিচারে এর কোনও মূল্য আছে কিনা তা নির্ধারণের কোনও সুযোগই এঁদের ছবিগুলিকে দেওয়া হয়নি। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। আজও সুকুমারের 'হাতিমি'-র জলে জঙ্গলের টানাপোড়েনে অনেক ভাল ছবি, দর্শকরা দেখতে পান না। কোন চলচ্চিত্রকারকে হয়তো তাঁর কাঙ্খিত ছবিটিকে অদল বদল করে নিতে হয় ওই হাতিমি দশায় পড়ে। নানান ফর্মূলানির্ভর নারী পুরুষের সম্পর্কের কচকচিতে ভরা সিনেমা জোর করে দর্শকের সামনে হাজির করা হয়। মুক্তি পাওয়ার আগেই মিডিয়াকে দিয়ে ছবিগুলির এমনই জয়গান গাওয়ানো হয় যে দর্শকরা সেই ছবি দেখে ভাল বলবেন না খারাপ বলবেন, তা বুঝেই উঠতে পারেন না। শেষ অবধি, সিনেমা যে আসলে কী তা তাঁদের জানাই হয়ে ওঠে না।

অথচ বারীন সাহার মতো একজন পন্ডিত চলচ্চিত্রকার বাংলা চলচ্চিত্র জগতে আর দেখা যায়নি। ভাল ক্যামেরাম্যানও ছিলেন। সিনেমার ইতিহাসে যে দুই চলচ্চিত্র আন্দোলন সারা দুনিয়ার সঙ্গে এই বঙ্গের চলচ্চিত্রকারদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল, বারীন সাহার চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটেছিল সেই দুই আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে বসে। বারীনবাবুর জন্ম ১৯২৫ সালে। প্রথাগত শিক্ষা শেষ করে ১৫ বছর বয়সে তিনি ভারতের অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। রাজনৈতিক কারণে তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছিল। যখন নিমাই ঘোষের 'ছিন্নমূল' বানানো হয়ে গিয়েছে, ঋত্বিক যখন 'নাগরিক' বানাচ্ছেন, সত্যজিত শুরু করেছেন 'পথের পাঁচালী'-র শুটিং আর মৃণাল সেন তখনও 'রাতভোর'-এর কাজ শুরুই করেন নি, সেই ১৯৫২ সালে, বারীন সাহা জেল থেকে বেরিয়ে বিদেশে পাড়ি দেন ফ্রান্সের বিখ্যাত চলচ্চিত্র বিদ্যালয় 'অঁস্তিতুত্‌ দেজ'অতে জেত্যুদ সিনেমাতোগ্রাফিক' থেকে চলচিত্র পরিচালনা ও সম্পাদনা নিয়ে স্নাতক হন। পরে ইতালির রোমে 'সেনত্রো স্পেরিমেন্তালে দি সিনেমাতোগ্রাফিয়া থেকে চিত্রগ্রহণ বিষয়ে স্নাতক হন। ফলে সে যুগের ফ্রান্সের 'নিউ ওয়েভ' ও ইতালির 'নিও রিয়েলিজম' চলচ্চিত্র আন্দোলনের উত্তেজনার মধ্যেই তিনি নিজেকে গড়ে নেবার সুযোগ পেয়েছিলেন বলা যায়। এর তিন বছর পর সেই অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করে সাত সমুদ্র পার হয়ে দেশে ফিরে মেদিনীপুরের তেরো নদীর ধারে তিনি তাঁর জীবনের প্রথম ও একমাত্র পুর্ণ দৈর্ঘের ছবির কাজ শুরু করেন নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। 'তেরো নদীর পারে' যখন তিনি তৈরি করছেন তখন সত্যজিত তৈরি করছেন 'অপুর সংসার', মৃণাল সেন তৈরি করছেন 'বাইশে শ্রাবণ' আর ঋত্বিক ঘটক ব্যস্ত রয়েছেন 'মেঘে ঢাকা তারা'-র কাজে। বাংলা অন্যধারার সিনেমার স্বর্ণযুগের সুচনা হচ্ছে।   

এই সময়টিকে চিনতে না পারলে নিমাই ঘোষ, বারীন সাহাকে চেনা যাবে না। সিনেমার সঙ্গে একটি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যোগসূত্র এতই নিবিড় হয় যে, এই মাধ্যমটির গায়ে তার ছাপ না পড়ে যায় না। সামাজিক পরিবেশ ও তার অভ্যন্তরীণ সংঘাতের স্পর্শে সিনেমা যুগে যুগে বদলে গেছে। বাংলায় পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সামাজিক পরিবেশই সম্ভব করেছিল প্রথাগত বানিজ্যিক বাংলা সিনেমার বাইরে নতুন এক ধরনের সিনেমাকেআর এই নতুন ধরনের বাংলা সিনেমার জন্ম দিতে তখন বাংলায় এমন কয়েকজন চলচ্চিত্রকার কোমর বেঁধে নেমেছিলেন, যাঁরা প্রথাগতভাবে চলচ্চিত্র নির্মানশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। ব্যতিক্রম একমাত্র বারীন সাহা। সেই সঙ্গে তিনি নিজের মধ্যে বহন করে এনেছিলেন সেই শহরের চলচ্চিত্র আন্দোলনের উত্তাপ যা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্ব জুড়ে চলচ্চিত্র নিয়ে দর্শকদের ধারণায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিচ্ছিলআগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকায় এমন সব সিনেমার সৃষ্টি হচ্ছিল যা সিনেমাকে তার হলিউডআশ্রিত বানিজ্যিক জগৎ থেকে টেনে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিল শিল্পের আঙিনায়। সিনেমা যে কেবলমাত্র বিনোদনের একটি মাধ্যম নয়, তার মধ্যে লুকিয়ে আছে শিল্পসৃষ্টির বিরাট সম্ভাবনা, তা ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল অন্য শিল্প আন্দোলনগুলির ঢেউ এসে লাগছিল চলচ্চিত্রর ফ্রেমে। সিনেমার মধ্যে দিয়ে মানুষের জীবন সংগ্রামের গল্প শোনানোর, তাদের লড়াইয়ের হাতিহার করে দেশের সমাজচিত্রকে তুলে ধরার একটা প্রবনতা বিশ্ব সিনেমায় দেখা যেতে শুরু করেছিল আধুনিক যুগের শিল্পী পেয়েছিল এমন এক আধুনিক শিল্প মাধ্যম যার মধ্যে দিয়ে সে নিজেকে অনেক সহজভাবে প্রকাশ করতে পারছিল। নতুন ভারতীয় ও বাংলা সিনেমাও সেই প্রবণতার থেকে মুক্ত ছিল না। নিমাই, ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মৃণাল সচেতনভাবে তাঁদের ছবিতে সেই সংগ্রামী, নামহীন মানুষদের সমাজকেই তুলে আনছিলেন। দেশে ফিরে বারীন সাহাও একই দিকে হাঁটলেন তাঁর নিজস্ব চলচ্চিত্র ভাবনাকে পাথেয় করে। বলাবাহুল্য, সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত বারীন সাহা সিনেমাকে নিয়ে যেতে চাইলেন স্টুডিওর মেকি পরিবেশ থেকে বাইরে উন্মুক্ত প্রান্তরে জনতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সিনেমা তৈরি করতে। এই ভাবনার মধ্যেকার আবেগকে আজ হয়তো আর তেমনভাবে বোঝা সম্ভব নয়, কিন্তু পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দিন বদলের বামপন্থী স্বপ্নে বিভোর বাংলায় তাকে সহজেই অনুভব করা যেত। 'জনতার মুখরিত সখ্যে' এসে দাঁড়ানোর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রবণতার সঙ্গে সিনেমার এই নয়াবাস্তববাদী তত্ত্ব সুন্দরভাবে মানিয়ে গেছিল।

'তেরো নদীর পারে', প্রথম একটি বাংলা ছবি যা সম্পূর্ণভাবে আউটডোরে শুটিং করা হয়েছিল বলে দাবি করা হয়। সেই আউটডোর লোকেশন ছিল মহিষাদল পার হয়ে হলদি নদীর ধারে 'তেরোপেখিয়া' নামের একটি গঞ্জ এককালে আজকের হলদি নদীকেই তেরো নদী বলা হতো। মহিষাদলের রাজা তেরোজন পাইক পাঠিয়ে এই গঞ্জ দখল করেছিলেন বলে নাম হয়েছিল তেরোপেখিয়া। সেখানে সিনেমা বানানোর যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে পৌছনো সহজ কাজ ছিল না। তা এতটাই দূর্গম ও বসবাসের অযোগ্য ছিল যে, কলকাতার অভিনেতারা সেখানে গিয়ে থাকতে রাজি হননি। ফলে শুটিং শুরু করেও বারীনবাবুকে বারে বারে অভিনেতা বদল করতে হয়। তিনি স্থানীয় লোকজনকে নানা চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলেন। এ সবই তিনি করেছিলেন নিজের বিশেষ এক চলচ্চিত্র ভাবনার জায়গা থেকে। যার ভিত্তি ছিল আঁন্দ্রে বাজাঁর 'ইমপিওর সিনেমা' তত্ত্ব অবিশুদ্ধ, কিন্তু হাতিমি দশায় দূষিত নয়। রেনোয়াঁর ভক্ত ছিলেন। ইতালির বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার সিজার জাভেত্তিনির ছেলের কাছেও ক্লাস করেছেন। যদিও নিজেকে নিও রিয়েলিস্ট হিসেবে দেখতে চাইতেন না কিন্তু তাঁর ছবির মধ্যে অনেক নিও রিয়েলিস্ট উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় মনে পড়ে যায় ফেলিনির 'লা স্ত্রাদা' ছবিটির কথা।           

মজার ব্যাপার অবিশুদ্ধ সিনেমার যে হাতিমির দশা নিয়ে আলোচনা করতে বসেছি 'তেরো নদীর পারে' ছবিতে বারীন সাহা সেই দশার উল্লেখ রেখে গিয়েছেন এক্ষেত্রে তাঁর মাধ্যমটি সিনেমার বদলে একটি সার্কাস ও তার শিল্পীরা সার্কাসে দর্শক টানতে ম্যানেজার নিয়ে এসেছে এক নর্তকীকে। যার টানে দর্শক আসবে সার্কাস দেখতে। আর অন্যদিকে সেই সার্কাসের ওস্তাদ, ম্যানেজারের এই পরিকল্পনাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না কারণ, তার মতে এতে সার্কাসের শিল্পী হিসেবে তার ওস্তাদিকে খাটো করা হবে। ম্যানেজার ও ওস্তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বসংঘাতই এই ছবির প্রধান বিষয়। সেই সঙ্গে এই দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে যে প্রশ্ন সামনে চলে আসে তা হল, সার্কাসে দর্শক আসবে ওস্তাদের খেলা দেখার টানে নাকি নর্তকীর যৌন আবেদনের টানে? ম্যানেজারের নর্তকীকে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য দর্শককে সার্কাসের তাঁবুতে ঢুকতে প্রলুব্ধ করাঠিক যেমন আজকের সিনেমা হলে দর্শক টানতে বানিজ্যিক ছবির প্রযোজকরা আইটেম নাম্বার যুক্ত করে থাকেন। মনে রাখতে হবে, বারীন সাহার আমলে সিনেমায় আইটেম নাম্বারের কোনো ধারনা ছিল না। কিন্তু শিল্পের সঙ্গে বিনোদন ব্যবসার লড়াইয়ের জায়গাটা যে অনেক পুরনো তা প্রমাণ হয়ে যায়। বাজাঁ কথিত "ইম্পিওর সিনেমা বা অবিশুদ্ধ সিনেমা" তত্ত্ব আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় যেন অন্য এক আলোয়  

আন্দ্রে বাজাঁ
আন্দ্রে বাজাঁ, ল্যুমিয়ের ভাইদের সৃষ্ট আদি, বিশুদ্ধ সিনেমার অন্য শিল্প মাধ্যমের (যেমন সাহিত্য, নাটক, অপেরা) শর্তগুলিকে আশ্রয় করা ও তাদের ওপর নির্ভরতা করার প্রবনতার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন "It thus seems as if cinema's themes have exhausted what it could expect to receive from technics. It is no longer enough to invent rapid editing or to alter one's film style in order to move the audience. Film has imperceptibly entered the age of the script. By this I mean that there has been a reversal in relations between form and substance." বাজাঁ সিনেমার ফর্ম অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে বলতে চাননিতিনি বুঝেছিলেন সিনেমা একটি নবজাতক শিল্প হিসেবে এগিয়ে চলেছে একটি নদীর মতন। এখন তাকে নির্লিপ্তভাবে না এগিয়ে চেষ্টা করতে হবে, তার তীরের বালি, মাটি সব কিছুকেই আতস্থ করে নিয়ে এগোতে কারণ চলচ্চিত্র, শিল্প হিসেবে এক ভারসাম্য রক্ষাকারী স্তরে পৌচেছে। যেখান থেকে সে তার ফর্মের সঙ্গে অন্য শিল্পকে মিশিয়ে নেবে চতুরভাবে। এই মিশ্রন তাকে সমৃদ্ধ করবে। কারণ "The days are gone when it was enough to 'make cinema' to merit the status of art.  সিনেমার গায়ে আগামী দিনে পড়তে চলেছে রঙের প্রলেপ ও থ্রী ডাইমেনশন প্রযুক্তির ছাপ যা নতুন এক ফর্মের সন্ধানের দিকে সিনেমাকে নিয়ে যাবে। যা অবশ্যই "set in motion a new cycle of aesthetic erosion" এবং আজকের "cinema has nothing left to achieve on its surface". কিন্তু হয়তো এমন দিন আবার আসবে "for a resurgence, for a cinema independent of literature and theatre – possibly, however, because novel will be written directly on cinema"বারীন সাহা 'চলচ্চিত্র দিয়ে উপন্যাস রচনা' করতে চেয়েছিলেন অন্যশিল্প নির্ভরতার বাইরে দাঁড়িয়ে, সিনেমার নিজস্ব শর্তকে মেনে, উন্নত, স্বাধীন এক চলচ্চিত্র শিল্পভাষার জন্ম দিতে। 'তেরো নদীর পারে' দেখতে বসলে তা বোঝা যায়।   

'তেরো নদীর পারে' কলকাতায় মুক্তি পায় দশ বছর পর। ছবিটির মুক্তি দিতে পরিবেশকরা রাজি ছিলেন না পরে সেই সময়ে কলকাতার বুদ্ধিজীবিদের চেষ্টায় ছবিটির মুক্তি সম্ভব হয়। মুক্তির আগে বারীন সাহা একটি স্বল্প দৈর্ঘের ছবি তৈরি করেন। যার নাম 'শনিবার'। বাদল সরকারের একটি নাটক নিয়ে এই ছবিটি তৈরি হয়েছিল একেবারে স্টুডিওর ফ্লোরের মধ্যে। 'তেরো নদীর পারে' ও 'শনিবার' একই সঙ্গে কলকাতার কয়েকটি হলে মুক্তি পায়। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই তা উঠিয়েও দেওয়া হয়। নিজের যথাসর্বস্ব দিয়ে বারীনবাবু ছবিগুলি বানিয়ে ছিলেন এই আশায় যে মুক্তি পেলে তিনি তাঁর লগ্নি করা টাকা ফেরত পাবেন। কিন্তু বাংলা সিনেমার ইন্ডাস্ট্রিতে অন্যস্বরের কোনও স্থান সেদিনও ছিল না, আজও নেই। ফলে কপর্দকশূন্য এক ব্যর্থ  চলচ্চিত্রকার হিসেবে বাকি জীবন তিনি কাটিয়েছিলেন মনের মধ্যে বিরাট এক হতাশাকে পুষে রেখে। জীবনে আর কখনও ছবি করার চেষ্টা তিনি করেন নি। কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন গ্রামে বিদ্যালয় গড়তে। মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতেন, কিন্তু পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি করার কোনও চেষ্টা তাঁর মধ্যে আর দেখা যায়নি। যে সিনেমাতে বিশ্বাস করে বারীন সাহা এই বাংলায় ছবি করতে শুরু করেছিলেন, অনেক ঠেকে বুঝেছিলেন যে বিদেশে চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর ছবিটি সমাদৃত হলেও, তাঁর ধরনের ছবির দর্শক বাংলায় তৈরি হয়ে ওঠেনি। তাই বলে নিজের বিশ্বাসের ভুমিকে ছাড়তে রাজি হননি, ছেড়েছিলেন সিনেমাকেই। অবশ্য তাঁকে যাঁরা কাছ থেকে জানতেন তাঁরা বলেন, মনে মনে সিনেমাকে ছাড়তে পারেননি বারীন সাহা। গ্রামের বাড়িতে বসে তিনি চিত্রনাট্য লিখতেন। তবে তা বাংলা বা ইংরেজিতে নয়, ফরাসি বা ইতালি ভাষায়। যাতে কেউ তা পাঠোদ্ধার করতে না পারেন। এর থেকে বাংলা সিনেমা জগতের প্রতি তাঁর অভিমানের মাত্রাটা বোঝা যায়।

'তেরো নদীর পারে' ছবির শেষে আমরা দেখি সার্কাসের ম্যানেজারকে সার্কাস ছেড়ে চলে যেতে। বারীন সার্কাসের ওস্তাদের পক্ষ নিয়ে তাকে রেখে দিয়েছেন তার নিজস্ব শিল্পের আঙিনায়। যেখানে প্রেমের থেকেও শিল্প বড় তার কাছে। মুসকিল হল, অবিশুদ্ধ সিনেমার গায়ে হাতিমির দশা লাগার পরে ম্যানেজার নয়, ওস্তাদেরই সার্কাস ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। ছবিতে যা ঘটেনি, তাই ঘটেছিল বারীন সাহা ও নিমাই ঘোষের জীবনে। কারণ, "হেথা হতে যাও পুরাতন", এখন পৃথিবী জুড়ে অবিশুদ্ধ সিনেমার গায়ে হাতিমির দশা লেগেছে।