কবি বিনয় মজুমদারের
‘ফিরে এসো চাকা’-নামের কাব্যগ্রন্থের নামে নাম, একটি ছবি আমি করেছিলাম। তবে সে
ছবিকে কোনভাবেই কাব্যগ্রন্থটির চিত্ররূপ বলা যাবে না, কারণ তেমন কিছু করার চেষ্টাই
আমি করিনি। ছবিটির প্রযোজক ছিল একটি টেলিভিশন চ্যানেল। যখন আমি তাদের আমার ছবির
ভাবনার কথা জানিয়ে ছিলাম, তারা চমকে উঠে
বলেছিল – ‘ফিরে এসো টাকা?’ সে আবার কেমন ছবি?’ আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাদের
চাকা ও টাকার গুণমাহাত্ম্যের তফাৎ বোঝাতে।
তারা কী বুঝেছিল
জানি, কিন্তু ছবিটি বানানোর অনুমতি দিয়েছিল। এজন্য আমি আজও তাদের কাছে
কৃতজ্ঞ। ফিরে এসো চাকা করার
সময় আমার সামনে এমন একটা পরিবেশ ছিল, যার মধ্যে সেই সময়
আমি দাঁড়িয়েছিলাম। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে শিল্পায়নের হুজুক উঠেছে। সরকারি
বামপন্থীরা পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াই ভুলে তাকে আবাহনের মন্ত্র আওড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষ
সেই মন্ত্র শুনে শিল্পায়ন না জানি কী এক আশ্চর্য
ব্যাপার ভেবে পটাপট ভোটের বোতাম টিপছে। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের নাম তখনও শোনেনি
কেউ।
নানা চিন্তা মাথায় ভিড়
করে আসছিল। একটা ভাবনা কী ভাবে ছবির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করা যায়, তা যে কোনও চলচ্চিত্রকার
নিশ্চয়ই ভেবে চলেন সর্বদা। বইয়ের তাক থেকে বিনয়ের ‘ফিরে এসো চাকা’ কাব্যগ্রন্থ পেড়ে নিয়ে পড়তে বসলাম।
‘চাকা’ শব্দটাতে মন আটকে গেল। চাকা মানে কি? প্রগতি, প্রগতি-সত্তা, প্রগতিশীলতা,
প্রগতি ভাবনা নাকি চাকা মানে ‘চক্রবর্তী’? নিতান্তই একটি পদবির
ইঙ্গিত। কাব্যগ্রন্থটিকে ঘিরে প্রেমার্তির চালু গুঞ্জন আমার মনে
একটা গল্পের আভাষ দিয়েছিল। প্রগতি প্রশ্নে তখন বঙ্গের রাজনীতিতে নতুন
ব্যাখ্যা উপস্থিত করছে সরকারি বামদলগুলি। পুঁজির সন্ধানে বিশ্বব্যাঙ্ক, আই এম এফ,
বিশ্বায়ন প্রভৃতি শব্দ লোকের মুখে-মুখে ফিরছে। প্রগতির
যে সংজ্ঞা এতদিন আমাদের জানা ছিল, সেই সংজ্ঞায় বদলের হাওয়া লেগেছে। সেই বদলে যাওয়া প্রগতিভাবনার
মধ্যে আমি এক কবির আত্মাকে খুঁজব আমার ছবির মধ্যে দিয়ে। কারণ, কবিরা হলেন জাতির
আত্মাস্বরূপ। যা জেগে থাকে নানা সমাজ বিবর্তনের ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যেও। এমনটাই আমার মনে হয়েছিল।
চিত্রনাট্য লিখতে বসে
বিনয় ও গায়ত্রীকে নিয়ে কবি মহলে চালু গল্পটিকে একটা আকার দিয়েছিলাম। সেই সঙ্গে
চেষ্টা ছিল, কাব্যগ্রন্থ থেকে বিনয়ের কয়েকটি কবিতাকে গল্পের সাবপ্লট
হিসেবে মিশিয়ে দেওয়ার। কবির ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন আমার বন্ধু জয় গোস্বামী ও
গায়ত্রীর আদলে তৈরি বিশ্বব্যাঙ্কের এক প্রবাসী বাঙালি কর্মী হিসেবে অনসুয়া
মজুমদার। আর আছেন কবির গুণমুগ্ধ এক কবিতা পত্রিকার সম্পাদক, দেবশংকর হালদার, একটি
এফ এম চ্যানেল ও একটি মেয়ে, যে কবির ভক্ত।
ছবিতে জয়কে দেখা গেছে
একটি গহ্বরের মধ্যে বসে কবিতা পড়ছে। স্থানটিকে একটা বিশেষ রূপ দেওয়া
হয়েছে। যেন কোন অতলে কয়েকজন আর্ত ও অবরুদ্ধ নারীর পাশে বসে কবি তাঁর কবিতা পাঠ
করছেন। যে কবিতাগুলি অন্য এক মাত্রা নিয়ে তাঁর প্রেমাস্পদের মননে এসে এক অনুরণনের সৃষ্টি
করছে। ছবির শুরুতে আমরা বুঝি না সেই অনুরণন অনসূয়ার চরিত্রটির
মধ্যে কোনও প্রভাব ফেলছে কিনা। কিন্তু তেমনই এক আশা নিশ্চয় জাগিয়ে
রাখতে চেষ্টা করে ছবিটি। এক অব্যক্ত প্রেম সারা ছবি জুড়ে ছেয়ে থাকে। অন্যদিকে
সমসাময়িক বঙ্গের শিল্পায়ন ঘিরে নয়া প্রগতিবাদের তরজা চলতে থাকে। ছবিটি সম্পর্কে লিখতে বসা আমার
উদ্দেশ্য নয়। তার জন্য সেটি দেখে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এটি করতে গিয়ে
কবিতা ও সিনেমার সম্পর্ক নিয়ে যে ভাবনা আমায় ঘিরে ধরেছিল তা নিয়ে আলোচনা করা
যাক।
কবিতাকে সিনেমার একটি
উপাদান হিসেবে ব্যবহারের প্রশ্নে আমাকে ভাবতে হয়েছিল। কী ভাবে ছবির বিভিন্ন উপাদান যেমন, কাহিনি, সঙ্গীত,
সংলাপ, ছবি, শব্দ ইত্যাদির সঙ্গে সহজে মিশিয়ে দেওয়া যায়। আমাদের
চারপাশে যে ধরনের সিনেমা হচ্ছে, তার মধ্যে প্রধান হলিউডের শেখানো সাহিত্য ও নাটক
ভিত্তিক সিনেমা। সেখানে সাউন্ড ট্র্যাকে সংলাপ, সঙ্গীত ইত্যাদির সঙ্গে কবিতাও
জায়গা করে নেয় কাহিনির প্রয়োজনে। এমনও দেখা যায়, চরিত্ররা
তাদের সংলাপ উচ্চারণ করছে পদ্যছন্দে। কিন্তু এই সমস্ত উদ্যোগে কবিতা, সিনেমার এক
স্বতন্ত্র উপাদান হিসেবেই রয়ে গেছে। সিনেমাটির সত্তায় পরিনত হয়েছে বলে
দাবি করা যায় না। আবার এমনও হয়, যখন কোনও ছবির দৃশ্য ও সঙ্গীত মিলেমিশে দর্শকের
মনে কাব্যময়তার অনুভুতি এনে দেয়। সে বলে তখন বলে, দৃশ্যটি ‘কবিতার মতো’।
আমাদের দেশে জি অরবিন্দন
বা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর মতো কয়েকজন পরিচালক এইভাবে কবিতাকে সিনেমার সঙ্গে মিশিয়ে
দিতে চেষ্টা করেছেন। বিদেশে থিও অ্যাঞ্জেলেপোলসের মতো চলচ্চিত্রকারদের সিনেমার
কাব্যময়তা উপভোগ করার মতো। এসব সত্ত্বেও,
নাটকের মতো, উপন্যাসের মতো, ছোট গল্পের মতো সিনেমা বানানো সম্ভব হলেও, কবিতার মতো সিনেমা
তৈরি যে কিছুতেই সার্থক হয় না, তার কারণ,
শিল্পসভার রাজাকে তার বোঝা না বোঝার জগৎ থেকে টেনে এনে সিনেমার ‘সব বুঝেছির আসরে’ দাঁড়
করাতে চাই বলে। এমন কোনও সিনেমা আমরা দেখতেই চাই না যার সবটা বোঝা যায় না। ‘কবিতার
বোঝাপড়া’ মানুষের অনুভুতির জগতেই ঘটে তাকে। যার সবটা বিশ্লেষণ করা অনেক সময় সম্ভব
হয় না। সিনেমাকে সেই ছাড়পত্র দিতে আমরা সহজে রাজি হই না।
প্রশ্ন হল, কবিতার মতো
সিনেমা বলতে কী বোঝায়? প্রায়শই আমরা কোনও
একটি চিত্রকলার দিকে তাকিয়ে বলে উঠি, খুব
ড্রামাটিক। কোনও নাটক দেখে বলি, মিউজিক্যাল। কোনও সঙ্গীত শুনে আমাদের মনে একটা ছবি
ফুটে ওঠে। আবার কোনও সাহিত্যপাঠ আমাদের পৌঁছে দেয় কাব্যিক অনুভূতির জগতে। এমন যখন
হয়, তখন মনে হয়, মানুষের শিল্পসভায় বিভিন্ন মাধ্যমগুলি একে অপরের সঙ্গে সংপৃক্ত
হয়ে আছে। আর তার মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে রসিক মানুষটি। এই শিল্পসভার অধিবেশন
শুরু হয়েছে মানুষের ইতিহাস শুরুর দিন থেকেই। আজও সে অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটেনি। কেবল
সাম্প্রতিককালে সেই সভায় এক নতুন সদস্যের আগমন ঘটেছে, যার নাম সিনেমা।
তাই সিনেমা আবিস্কারের পর থেকেই মাধ্যমটির সম্ভাবনাকে বুঝে নিতে নানা দেশে নানান পরীক্ষা
নিরীক্ষা যেমন হয়েছে, তেমনি মাধ্যমটিকে ঘিরে নানা শিল্পতত্ত্বও সৃষ্টির চেষ্টাও কম
হয়নি। নির্বাক যুগ থেকেই সিনেমা নিজের ভাষা আবিস্কার করতে চেয়েছে তার চারপাশে
ছড়িয়ে থাকা অন্য শিল্প মাধ্যমগুলির উপাদান আত্মস্থ করার মধ্যে দিয়ে। তাই সিনেমার
শরীরে সাহিত্যকলা, নাটকলা, নৃত্যকলা, চিত্রকলা, সঙ্গীতকলা সবারই স্পর্শ লেগেছে। ফলে,
আন্দ্রে বাজাঁর মতে তা হয়ে উঠেছে ‘Impure Cinema’। এই নানা শিল্পের সংস্পর্শে
এসেই ক্রমে ক্রমে সিনেমা খুঁজতে চেয়েছে
এমন এক ভাষাকে, যা একান্তভাবেই তার নিজস্ব বলে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। যে ভাষায় অন্য
শিল্প মাধ্যমগুলির ভাব থাকলেও, ছাপ থাকবে না। রাশিয়ায় বসে জিগা ভের্তব তাঁর ‘ম্যান
উইথ এ মুভি ক্যামেরা’ ছবি সম্পর্কে যেমন বলেছিলেন, ‘The film presents an
experiment in the cinematic communication of
visible events without the aid of inter-titles (a film without inner titles),
without the aid of scenario (a film without a scenario), without the aid of
theatre (a film without actors, without sets etc.). This experimental work aims
at creating a truly international absolute language of cinema based on its
total separation from the language of theatre and literature.’ এই absolute language of cinema – র খোঁজ শুরু হয়েছিল রাশিয়াতেই।
সোভিয়েত সমাজে সিনেমার
স্বাধীন ভাষার সন্ধানে যে মানুষটি আমাদের চিন্তায় বিপ্লব ঘটিয়ে ছিলেন, তিনি
নিশ্চয়ই সের্গেই আইজেনস্টাইন। মনে রাখতে হবে, আইজেনস্টাইন তাঁর সিনেমার ‘মন্তাজ’ তত্ত্বকে
প্রতিষ্ঠিত করতে জাপানের ‘হাইকু’ কবিতার প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। তাই বলা যায়, সিনেমাকে
যে শিল্পরূপের খুব কাছের বলে মনে হওয়া সম্ভব, তা কিন্তু কবিতাই। অথচ বাণিজ্যিক
স্বার্থ সিনেমার ভাষার অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে সাহিত্য ও নাটকের দিকে।
এর কারণ আমেরিকায় গ্রিফিথ
সাহেবের ‘বার্থ অফ এ নেশন’ ছবির সাফল্য। সিনেমার মধ্যে দিয়ে উপন্যাসের ঢঙে গল্প বলা
হলে তা যে দর্শকদের বেশি আকর্ষণ করে, তা সকলেই মেনে নিয়েছিল। হলিউড যেহেতু
বাণিজ্যনির্ভর সিনেমাকেই পাথেয় করেছিল, তাই হলিউডের ছবির প্রভাব সারা পৃথিবীতে
ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য ও নাটক নির্ভর সিনেমাই হল আসল সিনেমা, এমন একটা
ধারণা সকলকে পেয়ে বসেছিল। সবাক যুগে যা আরও শক্তিশালী হল। যদিও ন্যারেটিভকে মেনে নিয়ে তারই মধ্যে চিত্রকলাকে গেঁথে
নেওয়ার প্রয়াস দেখা গেল জার্মানিতে ‘Expressionist’ সিনেমা, ফ্রান্সে ‘Impressionist’ গোত্রের ছবি তৈরি মধ্যে দিয়ে। যা ইংল্যন্ডে হিচককের মতো
পরিচালকের প্রথম দিককার ছবিগুলিকে প্রভাবিত করল। সবাক যুগ এসে গেলেও সিনেমায়
ইঙ্গিত ও বিশুদ্ধ পদবিন্যাসগুলির (Sign & Syntax)
ব্যবহারের দিকে তাকালে বোঝা যায়, সংলাপকে দূরে
রেখে সাহিত্য ও নাটক থেকে সিনেমার ন্যারেটিভকে আলাদা করার একটা প্রয়াস তখনও রয়েছে।
অন্যান্য শিল্পের বিভিন্ন আন্দোলনের ছাপ পড়ছে সিনেমার ভাষা ও আঙ্গিকে। সে আন্দোলন
সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত যারই হোক না কেন। এই ধারা বিগত শতাব্দীর পাঁচের দশক
অবধি লক্ষ্য করা গেছে। যার কিছু চিহ্ন রয়ে গেছে আজকের যুগের সিনেমার মধ্যে। কেবল
সচেতনতার অভাবে তা আর আমাদের নজরে পড়ে না। এই ভাবেই সিনেমায় কবিতার কাব্যময়তার
ছোঁয়া প্রথম লাগে ফরাসি দেশের ‘পোয়েটিক রিয়েলিজম’ সিনেমা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে
(যদিও দুয়ের দশকে ফরাসি দেশে ইম্প্রেশানিস্ট চলচ্চিত্রকারদের মধ্যেও কবিতা ও
সিনেমার সম্পর্ক ব্যাপারে সচতেনতা ছিল)। বিগত শতকের তিনের দশকে জাঁ রেনোয়াঁ,
মার্সেল কার্নে, জুলিয়েন ডুভিভিয়ের প্রভৃতি চলচ্চিত্রকার এই ধরনে সিনেমা বানাতে
শুরু করেন। এঁদের ছবিতে সেই সময়ের ফরাসি দেশের যাবতীয় কঠিন সামাজিক বাস্তব
পরিস্থিতি থেকে উদ্ভুত হতাশাকে কাব্যময়তা দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা ছিল। এখানে
কাব্যময়তা বলতে সমাজের নিচুতলার মানুষের কঠিন জীবনের কাহিনিকে, নিপুণ দক্ষতা দিয়ে
তৈরি সুন্দর সেট, ক্যামেরার নড়াচড়ার সঙ্গে চরিত্রদের চলাফেরার ছন্দোবদ্ধতা (Mise-en-Scene), আলোর ব্যবহার ও পরিকল্পনা, চরিত্রদের পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদির
ব্যবহারের দিকটিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন ভাবে কবিতায় শব্দের চয়ন করা হয় অত্যন্ত
নিষ্ঠার সঙ্গে ঠিক তেমন ভাবেই। তবে এ সবই সিনেমার নিজস্ব ভাষার সন্ধানের ফলশ্রুতি হলেও,
সোভিয়েত মন্তাজ আন্দোলন ও ইতালির নিও রিয়ালিজম আন্দোলন সিনেমাকে যতটা ভাষার
নিজস্বতা দিতে পেরেছিল, তা অন্যান্য সিনেমা আন্দোলনগুলি পেরেছিল কিনা তা নিয়ে তর্ক
চলতে পারে।
কিন্তু আমরা খুঁজতে বসেছি
সিনেমায় সিনেমার ভাষা দিয়ে কবিতা রচনার সম্ভাবনাকে। তাই আমাদের দৃষ্টিকে কিছুটা
নিয়ন্ত্রিত করে নেওয়া যাক কবিতা ও সিনেমার সম্পর্কের পরিধির মধ্যে। আমার মতে, এই
সম্পর্কের প্রথম বীজ বপন করা হয়েছিল সোভিয়েত মন্তাজ আন্দোলনের সময় আইজেনস্টাইন,
জিগা ভের্তভদের হাত ধরে। বিগত শতাব্দীর দুইয়ের দশক থেকে সাতের দশক পর্যন্ত
পোয়েট্রি ফিল্ম বা ফিল্ম পোয়েম সৃষ্টির নানা পরীক্ষার পর, একটা পূর্ণতা পায় সেই রাশিয়ারই
আর এক চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেই তারকভস্কির হাত ধরে। বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়
বলে আলোচনার কিছু সুত্র রেখে যাওয়া যেতে পারে।
আমার মতে, আধুনিক কবিদের
উদ্যোগেই সিনেমা দিয়ে কবিতা রচনার ভাবনা শুরু হয়েছিল। আমেরিকায় ছয়ের দশকে নব্যধারার
চলচ্চিত্র তৈরির হাওয়া ওঠে প্রধানত টেলিভিশনের প্রচন্ড উপস্থিতিকে সামলাতে। ‘নিউ হলিউড’ আন্দোলন যখন হলিউডের চিরন্তন স্টুডিও নির্ভর চলচ্চিত্র ভাবনাকে
বদলে দিচ্ছে, তখন সেখানে মায়া ডেরেন, স্ট্যানলি ব্র্যাকেজ, জোনাস মেকাসদের মতো স্বাধীন
চলচ্চিত্রকাররও কাজ করছেন। এঁদের ছবির ভাবনায় উঠে আসছিল সিনেমাকে অন্যান্য শিল্প
মাধ্যমগুলির মধ্যে রেখে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা। আর নিজেদের ‘ফিল্ম পোয়েট’ হিসেবে দাবি করার
ঝোঁক। সেটা করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা প্রথমে অস্বীকার করেছিলেন হলিউডি
ঘরানার ছবিকে। এমন কী সিনেমায় সাহিত্য ও নাটকের উপস্থিতিকেও তাঁরা মেনে নেননি।
তাঁরা নিজেদের আধুনিক কবি বলেই মনে করতেন। তফাৎ শুধু, তাঁরা শব্দের
বদলে ‘ইমেজ’-এর সাহায্যে কবিতা লেখেন। মায়া ডেরেনের ছবি ‘Meshes of the
Afternoon’ বা ব্র্যাকেজের ‘Dog Star Man’ সিরিজ যাঁরা
দেখেছেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন সিনেমা নিয়ে এঁরা ঠিক কী করতে চেয়েছিলেন। ব্যাকহেজ
লিখেছেন, ‘there is a pursuit of knowledge foreign to language and founded upon
visual communication, demanding a development of the optical mind, and
dependent of the particularities of the medium in the original and deepest
sense of the word’। এই যে ‘pursuit of knowledge foreign to language’ বলা হল, এখানেই সিনেমা দিয়ে কবিতা রচনার মূল সুত্রটি লুকিয়ে
আছে বলে আমার মনে হয়।
‘চলচ্চিত্রবিতা’ বা
কবিতা-সিনেমা নিয়ে আমেরিকা, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে চলচ্চিত্র উৎসব হয়ে থাকে।
এমনকী চলচ্চিত্রবিতা বানানোর রীতি-রেওয়াজ নির্ধারণ করে দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে
অনেকটা ডেনমার্কের ‘ডগমে’ চলচ্চিত্র আন্দোলনের মতো। যেখানে বলা হয়েছে, সেইসব চলচ্চিত্রকে
‘চলচ্চিত্রবিতা’ বলে গণ্য হবে, যেগুলি তৈরি হয়েছে খুবই অল্প সংখ্যক কলাকুশলী নিয়ে।
ছবির দৈর্ঘ্য কম হতে হবে। ছবিটি বানাতে তিন দিনের বেশি সময় লাগবে না ইত্যাদি। এতো
করেও কিন্তু সিনেমা-কবিতা বা চলচ্চিত্রবিতার সংজ্ঞা ধোঁয়াশাই রয়ে গেছে।
একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে
আমার মত হল, সিনেমাকে কবিতার ধাঁচে ফেলতে গেলে প্রথমে যা করা দরকার, তা হল, সিনেমা
তৈরির পুরনো পদ্ধতি অর্থাৎ নাটকের লজিক থেকে বেরিয়ে এসে কবিতার লজিকে বসানোর
চেষ্টা করা। আন্দ্রেই তারকভস্কি সেটাই
করেছিলেন। তিনি সিনেমার বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে কবিতাকে মেশাতে চেষ্টা না করে তার
খোল নলচেটাই বদলে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কবিতার সৃষ্টি হয় কখনও একটি মাত্র
শব্দ থেকে। আবার কখনও হঠাৎ আসা একটিমাত্র লাইন থেকে। কবি হয়তো সেই
লাইনটি লিখে ফেলেন, কিন্তু তখনও জানেন না পরবর্তী লাইনগুলি কী হবে বা শেষ পর্যন্ত
কবিতাটি কেমন আকার নেবে, কী-ই বা বলবে। তারকভস্কি লিখেছেন, তিনিও ছবি করতেন ওই একই
ভঙ্গিতে। নিজে কবি না হলেও তাঁর পিতা ছিলেন কবি। যাঁর প্রভাব তারকভস্কির উপর
পড়েছিল। তিনি ছবি করতেন ‘irrational creative’ পদ্ধতিতে। একজন কবি তাঁর কবিতা নির্মাণ করেন এই একই
পদ্ধতিতে। তারকভস্কির ছবিতে কাহিনির আভাষ থাকলেও সে কাহিনীর সবটা কথায় প্রকাশ করা
সম্ভব হয় না। ‘মিরর’, ‘স্টকার’ প্রভৃতি ছবি দেখা দর্শকের কাছে নতুন অভিজ্ঞতার মতো।
ঠিক যেমন সার্থক কবিতা পড়ে পাঠকের হয়।
এই সূত্রেই মনে আসে রবীন্দ্রনাথের ‘দ্য চাইল্ড’ নামের ইংরেজি কবিতাটির কথা। যা গোড়ায় লেখা হয়েছিল একটি চিত্রনাট্যের ভাবনা
হিসেবে। রাশিয়ায় গিয়ে রবীন্দ্রনাথ আইজেনস্টাইনের ছবি দেখে খুবই বিচলিত হয়ে
পড়েছিলেন বলে শোনা যায়। তাঁকে সিনেমা বিষয়ে আলোচনার মধ্যে নিয়ে এলে,
তিনি নাকি একটি ছবির ভাবনার কথাও বলেছিলেন। যার
শুরুর শটটি হবে, একটি গিরিশৃঙ্গের উপরে একজন ঋষি বসে আছেন। তারকভস্কির সেই irrational
creative – পদ্ধতি তো এইভাবেই শুরু হয়। হঠাৎ
একটা শব্দ, একটা বাক্য বা একটি শট জন্ম
দিচ্ছে একটি সিনেমার বা সিনেমা-কবিতার। পরে কি হবে স্রষ্টা নিজেই তখনও জানেন না। কিন্তু যাই হোক তা হবে কবিতার লজিকে। রবীন্দ্রনাথ, পরে সেই সিনেমা ভাবনাকেই
বিস্তার করে লিখেছিলেন তাঁর একমাত্র সিনেমার চিত্রনাট্য ‘দ্য চাইল্ড’। যাকে আমরা তাঁর
লেখা ইংরেজি কবিতা বলে জানি। পরে,
যা বাংলায় ‘নবজাতক’ নামে খ্যাত হয়। তাহলে একথা কী বলা যায় না যে, দ্য চাইল্ড ছিল রবীন্দ্রনাথের করা Film Poem –এরই একটি ভাবনা। দ্য চাইল্ড –এর লাইনগুলোকে যদি
শটে ভাগ করে নেওয়া যায় তবে তার চেহারাটা দাঁড়াবে একটি সিনেমা-কবিতার মতই। তারকভস্কির যে কবিমন ছিল তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সিনেমার
প্রযুক্তিগত কৃৎকৌশল সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা। আর তাই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল
সার্থক ‘সিনেমা-কবিতা’ সৃষ্টি করার। রবীন্দ্রনাথের কবিমনের সঙ্গেও সিনেমার
প্রযুক্তিগত কৃৎকৌশলের জ্ঞান যদি যুক্ত হত হয়ত তাঁর হাতেই তৈরি হয়ে উঠত বাঙালির
প্রথম সিনেমা-কবিতা সেই ১৯৩০ সালেই। ‘নটীর পূজা’ তাঁর করা একমাত্র সিনেমার
গ্লানিকর পরিচয়ের বিড়ম্বনা থেকে তিনি হয়তো মুক্তি পেতেন।
সিনেমা নিয়ে আজ পর্যন্ত
যত পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে তার সবচেয়ে সার্থক রূপ আমরা দেখি তারকভস্কির ছবির মধ্যে
দিয়েই। যেখানে এসে সিনেমা, সেই আইজেনস্টাইন, জিগা ভের্তভের হাত ধরে
পোয়েটিক রিয়্যালিজম ও নিও রিয়ালিজমের আঙ্গিনায় স্নাত হয়ে তারকভস্কির মধ্যে দিয়েই
সত্যিকারের এক নতুন ও স্বাধীন ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয়।
তবে এ কথাও ঠিক, শিল্পভাষাকে কখনও কি একটি মাত্রায় বেঁধে দেওয়া সম্ভব? তাই সব
শিল্পের ভাষা নিয়ে যে পরীক্ষানিরীক্ষা আজও চলছে, তেমনিই সিনেমার ভাষা নিয়েও চলতেই
থাকবে। আসলে শিল্প তো মানুষেরই অস্তিত্বের প্রকাশ। তার অস্তিত্বের সংকট যত বাড়বে
বা বদলাবে, শিল্পের ভাষাও বদলাবে তার সঙ্গে পাল্লা দিতে। না হলে শিল্পের আর কী কাজ?