খুব সহজভাবে শুরু করা যাক। সিনেমাকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অঙ্গ বলে মেনে নিলে এ কথা বলতে হবে, যা কিছু সিনেমার মাধ্যমে প্রকাশ পায় তার সবটাই মানুষের সমাজেরই নানা পরিচয়। এই পরিচয় সিনেমার ইতিহাসের পথ বেয়ে বিভিন্ন রূপ নিয়েছে। গত একশো বছরের কিছু বেশি সময় ধরে সিনেমা বিশ্বজুড়ে মানুষের সমাজের নানা চেহারা আমাদের সামনে এনে হাজির করেছে। সেই সব দৃশ্য ক্রমে- ক্রমে মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য-পরিচয় ও তার রক্ষণাবেক্ষণের কাজে সহায়ক হয়েছে। তিরিশের দশকে তৈরি কোনও বাংলা সিনেমায় চরিত্ররা যখন শহর কলকাতার রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছেন অথবা গাড়ি চালিয়েছেন, তখনকার দর্শকদের কাছে তা নিতান্তই একটি শহরের পথের দৃশ্য হিসেবে ধরা দিলেও আজকের দর্শকদের কাছে তা আরও বেশি কিছু। যেমন, সেদিনের চৌরঙ্গী রোড বা গাড়িগুলির চেহারা ঠিক কেমন ছিল তা ওই ছবির মাধ্যমে আমরা সহজেই জেনে যাই। এই ভাবে আমেরিকার দাস ব্যবস্থার ভয়াবহ রূপ, গ্রীসের সম্রাটদের রাজকীয় আচার আচরণ, আলেকজান্ডারের বিশ্বজয়, মোঘল সম্রাট থেকে শুরু করে এসকিমোদের জীবনযাপনের পরিচয়, বিশ্বযুদ্ধ, মানুষের প্রেম ইত্যাদি ধরা আছে বিশ্বসিনেমার গায়ে।
মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে এই সব ছবি আমাদের যে পরিচয় করিয়ে দেয় তার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠেছে আধুনিক চেতনায়। বলা হয়েছে, ইতিহাসকে চিত্রায়িত করার প্রক্রিয়ার মধ্যে যে দৃষ্টি ভঙ্গি ব্যবহার করা হয়েছে তার গোড়ায় রয়েছে পুরুষ চেতনা। পুরুষের দৃষ্টির ভঙ্গি দিয়ে (Male Gaze) মানুষের আবহমান কালের ইতিবৃত্তকে তুলে আনা হয়েছে সিনেমার ভাষায়। এ ধরনের সিনেমার নাম দেওয়া যাক ‘প্রথম ছবি’। অর্থাৎ মানুষের ইতিহাসকে সিনেমার মধ্যে দিয়ে প্রথম দৃষ্টি মেলে দেখা ছবি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে বিধ্বস্ত মানুষ তার চেতনায় বদল আনার তাগিদ অনুভব করতে শুরু করে। এত দিনের
আপাত শান্ত কিন্তু অসাম্যে ভরা মানুষের সমাজের যথার্থতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে পড়ে যেমন, তেমনি নারী ও পুরুষের মিলিত সমাজেও একটা বিভাজন রেখা ফুটে উঠতে শুরু করে। পুরুষ যা জানে বা বোঝে ঠিক একই ভাবে নারী যে বোঝে বা দেখে, এই চেতনা ক্রমশ স্বীকৃতি পায়। নারীদেরও যে একটা মন আছে, তাদেরও যে একটা দৃষ্টি ভঙ্গি আছে, তারাও যে কিছু বলতে চায় ও বলতে পারে তার দাবি বিশ্বময় জোরদার হয়ে ওঠে। নারীমুক্তির দাবির প্রকাশ যেমন ঘটতে থাকে সাহিত্যে, সঙ্গীতে তেমনি সিনেমাতেও। ফলে দ্বিতীয় এক দৃষ্টিভঙ্গির অস্তিত্ব ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির (Female Gaze) সামনে দাঁড়িয়ে যে সিনেমা বিশ্বময় তৈরি হতে শুরু করে, তাকে দ্বিতীয় সিনেমা বা ছবি বলা যেতে পারে। পুরুষের দৃষ্টি ও নারীর দৃষ্টি নিয়ে তৈরি দুই ধরনের সিনেমা-বোধে (Film Sense) বিভক্ত হয়ে যায় গোটা বিশ্ব সিনেমার জগৎ। দর্শকরা এমন সিনেমা দেখতে শুরু করেন যার গঠন, দৃষ্টিভঙ্গিমা ও বক্তব্য তৈরি হয়ে উঠেছে একজন নারীর মনজগৎ থেকে। এর ফলে যেমন একদিকে দর্শক হিসেবে আমরা পেয়ে যাই এক নতুন ধরনের ছবি, তেমনি কোনও জানা বিষয়ের ভাষ্যও যেন বদলে গিয়ে নতুন হয়ে ধরা পড়ে দর্শকদের কাছে। আরও একটা প্রয়োজনীয় ব্যাপার সকলের সামনে চলে আসে। তা হল, নারী মনের সম্পর্কে একটা ধারণা ক্রমশ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে। সেই মন যে পুরুষের মনের থেকে আলাদা, তারও যে বিশেষ এক চলন আছে, ভাঙাগড়া আছে, সেই মন যে কোমলতার পাশাপাশিই কঠিনও হয়ে উঠতে পারে, প্রতিবাদে সোচ্চার হতে পারে, পুরুষের একাধিপত্যকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে – সবই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো বিশ্বময় সিনেমার পর্দায় আছড়ে পড়তে লাগল। মনে রাখতে হবে এই সব ছবি কিন্তু কেবলমাত্র নারীকেন্দ্রিক বা নারীদের দ্বারা তৈরি, এমন নয়। সিনেমার ইতিহাসে প্রথম মহিলা পরিচালক হলেন ফরাসী দেশের 'অ্যালেস গি ব্লাশে'।
অ্যালেস গি ব্লাশে' |
এই যে নারীবাদী (Feminist) চলচ্চিত্র তৈরি হতে শুরু করেছিল তারই অভিঘাতে কিছুদিনের মধ্যেই আরও কয়েক ধরনের চলচ্চিত্রের জন্ম নিল যাদের গোত্র নির্ধারণে নানা বিতর্ক পার হয়ে অবশেষে নাম নিল 'এল জি বি টি'-দের সিনেমা। 'এল জি বি টি' এই অক্ষরগুলি যে ইংরেজি শব্দগুলির প্রতিনিধিত্ব করছে সেগুলি হল, এল – লেসবিয়ান (নারী সমকামী), জি – গে (পুরুষ সমকামী), বি – বাইসেক্সুয়াল (উভলিঙ্গগামী) ও টি – ট্রান্সজেন্ডার (হিজড়া)। অতএব বিশ্ব সিনেমার পরিবারে নতুন সদস্য হিসেবে এই ছবিগুলির উদয় হতে শুরু করল। যাদের একত্রে 'ক্যুয়ের' (Queer) বা 'অস্বভাবী' চলচ্চিত্র বলে চিহ্নিত করলেন কেউ কেউ। এই ক্যুয়ের বা অস্বভাবী চলচ্চিত্রকেই 'তৃতীয় ছবি'-র গোত্রভুক্ত বলা চলে। ঠিক যেমন ভাবে নারী ও পুরুষ লিঙ্গের বাইরে অন্য এক লিঙ্গের স্বীকৃতি দিতে গিয়ে 'তৃতীয় লিঙ্গ'র কথা বলা হচ্ছে, তেমনি ভাবেই বিশ্ব সিনেমাও পুরুষের দৃষ্টির আদি যুগ পার হয়ে নারী চলচ্চিত্রকারদের যুগে প্রবেশ করার পর আজ তৃতীয় বা অস্বভাবী দৃষ্টির যুগে এসে দাঁড়িয়েছে এবং এই তৃতীয় বা অস্বভাবী দৃষ্টিতে ছবি (Queer Cinema) বিশ্ব জুড়ে তৈরি হচ্ছে। যার থেকে ভারতীয় ও বাংলা সিনেমার জগৎও স্বভাবতই মুক্ত নয়। যার মধ্যে আমাদের দেশের 'না জানে কিঁউ', ফায়ার, ইত্যাদি যেমন আছে, তেমনি বাংলায় 'আরেকটি প্রেমের গল্প', 'মেমোরিজ ইন মার্চ' ও হাল আমলের 'চিত্রাঙ্গদা'র মতো ছবিও আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও 'কমন জেন্ডার' নামে একটি ছবিকে ঘিরে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
অস্বভাবী যৌনতাকে ঘিরে তাত্ত্বিক আগ্রহ এতটাই হল যে, দেখা গেল সেই ১৮৯৫ সালের নির্বাক যুগের সিনেমা থেকে শুরু করে আজ অবধি প্রায় প্রতিটি বছরে কোনও না কোনও দেশে অস্বভাবী চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে বলে দাবি উঠল। ১৮৯৫ সালে উলিয়াম ডিকসনের তৈরি প্রথম সবাক চলচ্চিত্রতে নৃত্যরত দুই পুরুষ চরিত্রের উপস্থিতির কারণে সেই ছবির মধ্যে অনেকে খুঁজে পেলেন ওই অস্বভাবী সিনেমার ছাপ। ১৯০৭ সালে তৈরি জর্জ মেলিসের তৈরি 'দ্য ইক্লিপ্স', ১৯১২ সালে অ্যালেস গি-র 'এলজি দ্য মাইনর' ইত্যাদি ছবির মধ্যেও অস্বভাবী সিনেমার ছোঁয়া পাওয়া গেল। পাওলো পাবলো প্যাসোলিনি, লুচিনো ভিস্কোন্তি, ফাসবিন্দারের মতো দিকপাল চলচ্চিত্রকারদেরকেও অস্বভাবী সিনেমার পরিচালক বলে প্রচার করা শুরু হয়ে গেল।
ভেরা চিটিলোভা |
এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জগৎকে দেখা শুরু হওয়ার পর থেকে মানুষের যৌনজীবন এসে দাঁড়াল সবার সামনে। সব কিছুর মধ্যেই মানুষের যৌনতাকে খোঁজার একটা প্রবণতা সমাজতাত্ত্বিকদের গবেষণাগার পার হয়ে এসে দাঁড়াল সাধারণ মানুষের জীবনের আঙ্গিনায়। জীবনের মধ্যে দিয়ে যৌনতাকে দেখার বদলে যৌনতার মধ্যে দিয়ে মানুষের জীবনকে দেখার পরিবেশ তৈরি হয়ে উঠল। মানুষের অস্তিত্বের লড়াইয়ের হাজারও সমস্যার মোকাবিলা ক্ষেত্রে 'যৌনকেন্দ্রিকতা' দখল করে নিলো প্রধান আসন। ফলে তার শিল্প-সংস্কৃতিতেও তার প্রভাব পড়ল। এর পেছনের রাজনৈতিক অভিসন্ধির দিকে কেউ তেমন খেয়াল করল না। যে তিন ধরনের ছবির উল্লেখ এখানে করা হয়েছে সব কটির উপরেই ক্রমশ এই যৌনকেন্দ্রিকতার প্রলেপ পড়ল কমবেশি। সিনেমা শিল্প মূলত একটি বাজার অর্থনীতি নির্ভর শিল্প হওয়ার কারণে এমনটা হতে পারল ওই অর্থনীতির নিয়ম মেনেই। বাজারজাত হতে গিয়ে দর্শকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার তাগিদ থেকেই বাণিজ্যিক সিনেমা মানুষের জীবনের আদি রসগুলির দিকেই হাত বাড়াল।
কিন্তু ব্যাপারটিকে অন্যভাবেও দেখা সম্ভব। আধুনিকতা মানুষকে এক শক্তি দিয়েছে। সে তার সমস্ত মানবিক প্রবৃত্তিগুলোকে স্বীকার করে নিয়ে তাকে প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে শিল্পকে ব্যবহার করতে শিখেছে। রক্ষণশীল ও ছুঁৎমার্গীদের কাছে সেটা গ্রহণযোগ্য না হলেও আমাদের আধুনিক জীবনের টানাপোড়েনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মেলে ধরার একটা তীব্র বাসনা যেন চেপে বসছে। বাজার অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী জীবনে সফল হবার মরিয়া চেষ্টা তাকে আরো বেশি করে পণ্য মানসিকতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর তাই নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা ও বিশিষ্ট করতে গিয়ে যৌনকেন্দ্রিকতার দিকে ঝুঁকেছে যেমন বিশ্ব বাজার তেমনি সেই বাজারের বাসিন্দারাও। ফলে যে দৃষ্টিভঙ্গিটি বর্তমানে সকলের সামনে চলে এসেছে সেটি হল এই LGBT বা ক্যুয়ের বা অস্বভাবী যৌনতা সিনেমার পরিমন্ডল। প্রায় খ্রীষ্টীয় কনফেশনের মতো ইদানিং আমরা শুনি কোনও পরিচিত শিল্পী তাঁর অস্বভাবী যৌনতাকে স্বীকার করে নিচ্ছেন জনসমক্ষে। তার শিল্পকর্মে অস্বভাবী ছাপের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে চাইছেন। একটি সিনেমাকে জনপ্রিয় করে তোলার সহজ পন্থা হিসেবেও এই প্রচেষ্টাকে দেখতে চাইতে পারেন কেউ কেউ।
সিনেমা যেদিন থেকে হাতিয়ার হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে, দেখা গেছে তার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা হয়েছে অনেক না বলা
কথা। আমাদের আলোচনার দ্বিতীয় গোত্রে সিনেমায় যে নারীবাদী সিনেমার প্রসঙ্গ এসেছে, সেখান দেখা গেছে নারীর উক্তির চরম প্রকাশ ঘটাতেই সিনেমাকে ব্যবহার করা হয়েছে। নারীমুক্তি আন্দোলনের হাতিয়ার হয়েছে সিনেমা। আবার অস্বভাবী সিনেমাতেও একইভাবে অস্বভাবী জনগোষ্ঠীর মানুষদের কথা জানাতেই তৃতীয় গোত্রের ছবি তৈরি হচ্ছে। পত্রপত্রিকায় তা নিয়ে আলোচনাও চোখে পড়ে। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায় এই গোষ্টীর মানুষদের জনসমক্ষে আসার সাহস জুগিয়েছে। মুম্বই শহরে একটি চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন হয় কেবলমাত্র এই কুয়্যের বা অস্বভাবী সিনেমার জন্যই। এই সব ছবির নির্মাতাদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের কাজের মুন্সিয়ানা যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি এ কথাও সত্যি যে এঁদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক পরিচালক ব্যক্তি জীবনে অস্বভাবী লিঙ্গের অধিকারী। কিন্তু তবু তাঁরা কেন এই ধারার ছবি করার দিকে ঝুঁকেছেন তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। অস্বভাবীদের যৌনজীবনের স্বীকৃতি সমাজকে একদিন না একদিন দিতেই হবে মানুষের সমাজ মুক্তির আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে। আপাতত সেই মুক্তি আন্দোলনের ছবিই ধরে রাখছে বিশ্বসিনেমা তার গায়ে। সত্যিকারের সমাজ মুক্তির পর তিন ধারার সিনেমাই আগামী প্রজন্মের কাছে হাজির হবে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভাণ্ডার হয়ে।